শিরোনাম
চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আগামীকাল শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের ইজারা দিলে দেশের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকীতে পড়বে গ্রামীণ মজুরদের কাজ, ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা দিতে হবে মিরপুরে আগুনে পুড়িয়ে শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে মশাল মিছিল জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করছেনা সিপিবিসহ চার বামদল জুলাই জাতীয় সনদের সর্বশেষ সংস্করণ সংশোধন না হলে স্বাক্ষর সম্ভব নয় আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার তদন্ত ও বিচার করতে হবে  মিরপুরের আনোয়ার ফ্যাশন ও কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সিপিবি ঢাকা মহানগর উত্তরের শোক ও সমবেদনা চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের লিজ দিতেই অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসেছে - সিপিবি এই সনদে সংবিধানের চার মূল নীতিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে

দেশকাল নিউজে সাংবাদিকতার অপেশাদারিত্ব ও নিউজরুম রাজনীতি

এক তরুণ প্রতিবেদকের অভিজ্ঞতা


দেশকাল নিউজে সাংবাদিকতার অপেশাদারিত্ব ও নিউজরুম রাজনীতি

শিতাংশু ভৌমিক অংকুর, 

সাংবাদিকতা আমার কাছে সবসময় ছিল এক ধরনের নৈতিক সাধনা। এই পেশায় পা রাখার সময় ভেবেছিলাম—এখানে থাকবে জিজ্ঞাসা, মানবিকতা, এবং সমাজ পরিবর্তনের দায়িত্ববোধ। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, আমাদের নিউজরুমগুলোর ভেতরেও এক ভয়ানক অসুস্থতা জন্ম নিচ্ছে—যার নাম অপেশাদারিত্ব ও ডার্টি নিউজরুম পলিটিক্স।

আমি দেশকাল নিউজে সাংবাদিকতা শিখতে গিয়েছিলাম। শেখার আগ্রহ ছিল প্রবল, স্বপ্ন ছিল বড়। কিন্তু হতাশার সঙ্গে বলতে হয়—এই জায়গাটিতে আমি যতটা জ্ঞান অর্জন করতে চেয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি শিখেছি ভয়, কৌশল, এবং নোংরা রাজনীতির মানে।

শুরুতে কাজের অভিজ্ঞতা তেমন খারাপ ছিল না। আমি প্রথমে ক্রাইম বিটে কাজ করেছি, পরে এনসিপি বিটে। কাজের চাপ, দায়িত্ব, কিংবা টাস্ক—এসব নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না। অফিস যেমন কাজ দিয়েছে, আমি করেছি নিষ্ঠার সঙ্গে। কারণ আমি বিশ্বাস করতাম—একজন সাংবাদিকের প্রথম ধর্ম পেশাদারিত্ব।

কিন্তু এই পেশাদারিত্বই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যখন নিউজরুমে নেতৃত্বের জায়গায় আসে এমন মানুষজন যাদের মূলে রয়েছে- গুটিবাজি, স্বজনপ্রীতি আর মিথ্যার চর্চা।

আগের চিফ রিপোর্টার অন্যত্র চলে যাওয়ার পর, তার জায়গায় রিপোর্টিং টিমেরই একজনকে স্থলাভিষিক্ত করা হলো ‘চিফ রিপোর্টার’ হিসেবে। কিন্তু তার পাশাপাশি চিফ রিপোর্টারের উপরে আরেকটি নতুন পদ সৃষ্টি করা হলো- সেটি হলো ‘রিপোর্টিং ইনচার্জ’। 

এই “ইনচার্জ” পদটি ছিল সম্পূর্ণ বানানো, ক্ষমতার সুবিধার জন্যই সৃষ্টি। আর এই পদে দায়িত্ব পেলেন অফিসের একজন ডেপুটি এডিটর, নাম ইশতিয়াক হোসেন। 

একজন ইনচার্জ বা সুপারভাইজারের কাজ হওয়া উচিত টিমকে গাইড করা, অনুপ্রেরণা দেয়া, আইডিয়া তৈরি করে সাংবাদিকদের মাঠে উৎসাহিত করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, দায়িত্ব নেয়া মাত্রই তিনি রিপোর্টিং বিভাগের ভেতর একধরনের ভয়, বিভাজন আর অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করলেন।

তিনি কখনো কোনো রিপোর্টের আইডিয়া দেননি, কাউকে প্রফেশনালভাবে গাইড করেননি। বরং দিনের পর দিন রিপোর্টারদের অকারণে অভিযুক্ত করে, মিটিংয়ে অপমান করে, মানসিক চাপ তৈরি করে আনন্দ পেয়েছেন।

আমি নিজে এর প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী। আমি তখন এনসিপি বিট করতাম। নিয়মিত মাঠে যেতাম, সোর্স তৈরি করতাম, তথ্য সংগ্রহ করতাম। কিন্তু মিটিংয়ে এসে আমার উপস্থিতি ও কাজের মান নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য শুনতে হতো। 

নিয়মিত মাঠে কাজ করলেও আমাকে বলা হতো—“তুমি তোমার বিটে যাও না”, “তোমার কাজ হয় না।” অথচ আমি জানি, প্রতিদিন এনসিপি অফিসে গিয়ে কত ঘণ্টা কাটিয়েছি, কত তথ্য সংগ্রহ করেছি।

 

 

 

 

আমার মনে হতো, এই ব্যক্তি আমাকে গাইড করতে নয়, বরং ধীরে ধীরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতেই এসেছেন। তার সঙ্গে কাজ করা মানে প্রতিদিন এক নতুন অজুহাতে নিজেকে ছোট হতে দেখা। এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিলাম যে, অফিসে যাওয়া মানেই মানসিক ভার নিয়ে যাওয়া।

এখন ভাবি, একজন সুপারভাইজারের কাজ তো সহকর্মীদের গাইড করা, সাপোর্ট দেওয়া। কিন্তু তিনি করতেন ঠিক উল্টোটা—সবার সামনে লজ্জিত করা, মিথ্যা গল্প তৈরি করা, আর সম্পাদকের কাছে এই ধারণা দেওয়া যে কেউই নাকি কাজ জানে না। যারা তাকে বোঝাতে চাইত, তাদেরও ‘অন্য দলে’ ফেলে দেওয়া হতো। এই অদ্ভুত পরিবেশে পেশাদার সাংবাদিকতা করা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।

এভাবেই দিনের পর দিন কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে মানসিকভাবে কোণঠাসা করা হলো। একসময় বুঝলাম, এটা শুধু আমার সঙ্গেই নয়—পুরো রিপোর্টিং টিমের সঙ্গেই ঘটছে। সবাই যেন নীরব আতঙ্কে বাঁচে, কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না, চাকরি হারানোর ভয়ে মুখ বন্ধ রাখে। 

এই ভয় ও অন্যায়ের সংস্কৃতি যখন কোনো নিউজরুমে প্রতিষ্ঠা পায়, তখন সাংবাদিকতা পেশা নয়—রাজনীতি হয়ে যায়। আর সেই রাজনীতির কেন্দ্রে থাকে মিথ্যা, গুটিবাজি, তেলবাজি আর ক্ষমতার খেলাধুলা। যে যার সুবিধা অনুযায়ী তা ব্যবহার করে। 

ধীরে ধীরে, অফিসে রাজনীতি তখন যেন নতুন রূপ নিল। কে কোন মতাদর্শে বিশ্বাসী, কে কার সঙ্গে কথা বলে—এইসব বিষয়ও প্রভাব ফেলতে শুরু করল কাজে। আমি যখন ডাকসু নির্বাচনের সময় এনসিপি বিট কাভার করছিলাম, তখন অফিস থেকে বারবার আকারে ইঙ্গিতে নির্দিষ্ট দলকে সুবিধা দিয়ে নিউজ করতে। শিবিরপন্থী একটি প্যানেলকে ‘প্রমোট’ করার জন্য প্রোপাগাণ্ডামূলক কনটেন্ট চাওয়া হতো। আমি সেই নির্দেশ অমান্য করেছিলাম। কারণ আমার কাছে সাংবাদিকতা মানে সত্য বলা, দল নয়।

কিন্তু আমার অবস্থান অনেকের চোখে ‘অবাধ্যতা’ হয়ে দাঁড়ায়। আমি দেখেছি আমার পাঠানো সঠিক ও যাচাই করা নিউজ বাদ দিয়ে মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা নিউজ প্রকাশ করা হচ্ছে। এরপর এনসিপির বিরুদ্ধেও ইচ্ছাকৃতভাবে নেতিবাচক রিপোর্ট লেখার জন্য আমাকে চাপ দেওয়া হয়। আমি রাজি হইনি। আজ মনে হয়, আমার চাকরি হারানোর পেছনে এটিও একটা বড় কারণ ছিল। 

যদিও প্রথম দিকে সম্পাদক নিজেই আমাকে এনসিপির পক্ষে নিউজ করতে উৎসাহিত করতেন। অফিসের অর্থায়নে এনসিপির এক পদযাত্রা কাভার করতেও পাঠানো হয়েছিল আমাকে। কিন্তু হঠাৎ করেই অবস্থান পাল্টে গেল। এনসিপির জায়গায় জামায়াত ও শিবিরকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু হলো। কোনো দলকে ভালো বা খারাপ বলা আমার বিষয় নয়, কিন্তু সাংবাদিকতাকে যখন ইচ্ছাকৃতভাবে একদলীয় হাতিয়ার বানানো হয়, তখন সেটা পেশার প্রতি অবমাননা ছাড়া আর কিছু নয়।

দিনে দিনে নিউজরুমের পরিবেশ আরও বিষাক্ত হয়ে উঠতে লাগল। ইশতিয়াক হোসেনের লাগাতার অপেশাদার আচরণে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ডিসেম্বর পর্যন্ত চাকরিতে থাকার কথা থাকলেও অক্টোবরে আমি নিজেই অব্যাহতি চেয়েছিলাম। কারণ তারা আমাকে যে অব্যবহিত পত্র পাঠিয়েছে সেখানে কোন কারণ উল্লেখ করেন নি বা আমাকে এর আগে কোন ধরণের সর্তক বার্তা  বা শোকজ নোটিশ ও করেন নি। তারা এটি অন্যায় করেছেন এবং আমাকে অব্যহতির বিষয়ে আমার সমস্যা কোথায় তা উল্লেখ করেনি, তা জানতে চেয়ে আমি  সম্পাদক বরাবর মেইল করে সিসি করে নির্বাহী সম্পাদক, রিপোর্টিং ইনচার্জ ও চিফ রিপোর্টকে মেইল পাঠাই কিন্তু তারা আমাকে কোন জবাব দেন নাই। তাই আমি নিজেই সম্পাদককে বলি ভাই আপনি যদি কারণ না বলতে চান তাহলে আমিই অব্যবহিত নিচ্ছি কিন্তু আমার নিয়োগ পত্রের শর্ত অনুযায়ী আমার প্রাপ্য আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তারপরও আশ্চর্য হয়েছি—আমার পাওনা বেতন যে চেকে দেওয়া হয়েছে সেটির তারিখ ডিসেম্বর। অর্থাৎ নভেম্বর মাসের জীবনযাত্রা কেমন হবে, তা কারও চিন্তার বিষয় হয়নি। এটা শুধু অব্যবস্থাপনা নয়, অমানবিকতাও বটে। 

 

এই সবকিছুর দায় কার? সম্পাদক নিশ্চয়ই অন্ধ ছিলেন না। কিন্তু তিনি যেভাবে তার সুপারভাইজারদের কথায় প্রভাবিত হয়েছেন, তাতে বোঝা যায়, নিউজরুম পরিচালনার চেয়ে তিনি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পরামর্শেই বেশি আস্থা রেখেছেন।

 

ছবি:সম্পাদকে অব্যবহিতর কারণ জানতে চেয়ে শিতাংশুর মেইলের স্ক্রিনশট।

 

সম্প্রতি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে আরও হতাশ হয়েছি। একাধিক সাবেক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হলো, যারা দেশকাল এখনো কর্মরত, কিন্তু নতুন জায়গা খুঁজছেন। তাদের মুখেও একই কথা—অফিসে এখন আগের চেয়েও ভয়াবহ পরিবেশ বিরাজ করছে।

 

 

 

তাদের মধ্যে একজন আবার দিলেন ভয়াবহ তথ্য, দেশকালের ইংরেজি বিভাগের এক সিনিয়র সাব এডিটরও সম্প্রতি রিজাইন করার সময় সম্পাদককে পাঠানো ইমেইলে (যা অফিসের সবাইকে সিসি করা হয়েছিল) উল্লেখ করেছেন, “সম্পাদকের অপেশাদার ও অমানবিক আচরণই” হচ্ছে তার চাকরি ছাড়ার মূল কারণ। এর পাশাপাশি তিনি পুরো প্রতিষ্ঠানের নানান অসংগতি তুলে ধরেছেন। 

এই সবকিছুই প্রমাণ করে—আমাদের মিডিয়া হাউজ গুলোর ভেতরে এখন যে অসুখ চলছে, সেটি কোনো একক ব্যক্তির নয়, বরং সাংগঠনিক সংস্কৃতির গভীর অসুস্থতা।

আজ সাংবাদিকতার পবিত্র স্থান—নিউজরুম—যখন মানসিক নির্যাতনের জায়গায় পরিণত হয়, তখন সেই জায়গায় সত্যিকারের সংবাদ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। একজন সাংবাদিক কেবল তখনই ভালো কাজ করতে পারেন, যখন তার মধ্যে নিরাপত্তাবোধ, স্বাধীনতা এবং সম্মান থাকে। 

কিন্তু যখন টিম লিডার নিজেই মানসিক চাপ তৈরি করেন, অপমানকে ব্যবহার করেন কৌশল হিসেবে, তখন সেটি পুরো প্রতিষ্ঠানের ওপর একধরনের বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আমি জানি, এই লেখা অনেকের জন্য অস্বস্তিকর হবে। হয়তো আমার ভবিষ্যতের কোনো চাকরির ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে। কিন্তু তারপরও লিখছি—কারণ এই অভিজ্ঞতা শুধু আমার না, এমন অসংখ্য তরুণ সাংবাদিক প্রতিদিন নিউজরুমের ‘ডার্টি পলিটিক্স’-এর শিকার হচ্ছে। তারা কেউ চাকরি হারাচ্ছে, কেউ মানসিকভাবে ট্রমায় ভুগছে, কেউ আবার চুপ করে যাচ্ছে। হয়তো যাদের নিয়ে সরাসরি বলছি, শুধুমাত্র তাদের হস্তক্ষেপে আমার অনেক জায়গায়ই চাকরি হবেনা। কিন্তু বলতেই হয়—কারণ চুপ থাকা মানে অন্যায়ের সহায়তা করা।একজন চিফ রিপোর্টার বা ইনচার্জ যদি মনে করেন তিনি টিমের মালিক, তবে তিনি ভুল করছেন। একজন সুপারভাইজারের কাজ হলো টিমকে তৈরি করা, ভাঙা নয়।সামনে আমার কর্মস্থল কোন প্রতিষ্ঠান হবে তা আমি জানিনা। তবে একজন টিম ভাঙার কারিগর হিসেবে রিপোর্টিং ইন চার্জ ইশতিয়াক ভাই এবং অমানবিক সম্পাদক হিসেবে পলাশ ভাইকে মনে রাখবো। আমরা যারা প্রতিদিন অন্যের অধিকার নিয়ে লিখি, অন্যের অন্যায় নিয়ে প্রতিবেদন করি—তাদের নিজেদের অন্যায়ের গল্পও একদিন লেখা উচিত। আমি সেই লেখাটাই লিখেছি আজ, নিজের চোখে দেখা এক নিউজরুমের অন্ধকার ইতিহাস।

 

লেখক- সংবাদকর্মী