‘সাঁতাও’: নান্দনিক হবার কুস্তি না-লড়লেও চলতো

মানস চৌধুরী


‘সাঁতাও’: নান্দনিক হবার কুস্তি না-লড়লেও চলতো

প্রেক্ষাগৃহে এই ছায়াছবিটা দেখার সুযোগ আমার অন্তত বার তিনেক ফস্কে গেছে। এমনকি হয়তো চারবার। এর মধ্যে বার দুয়েক ঘটেছে নির্মাতার সাথে আমার সাক্ষাৎ-পরিচয় ঘটবার পর। নিজেই দেখতে আগ্রহী ছিলাম, তার মধ্যে এই পরিচয়ের পর কমবেশি সেটা কর্তব্যচাপেও ফেলেছিল। কিন্তু কোনোভাবেই ক্লিক করেনি। শেষমেশ দেখার জন্য আমার নির্মাতার দেয়া বাড়তি সুযোগই গ্রহণ করা লেগেছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ ঘটে থাকতে পারে, নির্মাণব্যয় গুরুতরভাবে কমে থাকতে পারে, ছবিসঞ্চালন অতিশয় আরামদায়ক হয়ে থাকতে পারে, তবুও আমার মতো অকৃতজ্ঞ ও কর্কশ দর্শককে ছবি দেখানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া পরিচালক থাকা সহজ বিষয় নয়। কপালগুণে আমার জীবনে এটা বারকয়েক সুলভে পেয়েছি। মানতে হবে চলচ্চিত্র-দেবতা আমার প্রতি স্নেহময়। এই জন্য নির্মাতা খন্দকার সুমনকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।

‘সাঁতাও’ একটা মরিয়া সাংস্কৃতিক কাজ। বাংলাদেশে ক্রমাগত সিনেমা হল অবলুপ্ত হবার বাস্তবতায়, সরকারী অনুদানের ছবিগুলো পর্যন্ত প্রদর্শনের পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাদি না পাবার দুর্দশায়, পৃষ্ঠপোষকদের কেবল কাতুকুতু ও উন্নয়ন-শ্লোগানধর্মি কাজকর্মে লগ্নি করার প্রবণতায়, যে কোনো সাংস্কৃতিক তৎপরতাই (খরুচে মাধ্যম হিসাবে চলচ্চিত্র তো বটেই) মরিয়া হতে বাধ্য প্রায়। উপরন্তু, ছবিটা নির্মিত হয়েছে ক্রাউড ফান্ডিংয়ে। এটার আগে নাম ছিল গণচাঁদা, যখন বাংলাদেশে কিছু অন্তত বামপন্থী দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড নগর অঞ্চলে গ্রাহ্য হতো। পদ্ধতিটা চলচ্চিত্রকারগণ গ্রহণ করার সময় থেকেই বৈশ্বিক ভাষার সাথে মিলিয়ে ‘ক্রাউড ফান্ডিং’ বলতেই তাঁরা স্বস্তি পান। কাজটা করবার মতো টাকাটা উঠলে আমারও বলতে কোনো বাধা নেই। নির্মাণ সাধনের তুলনায় ভাষার তর্জমা বা কাস্টমাইজেশন নেহায়েতই গৌণ প্রসঙ্গ। ছবিটার মরিয়াপনা বুঝতে হবে বাংলাদেশের শিল্পসংস্কৃতি প্রবণতাতে ক্রমাগত জরুরি ‘গল্পগুলো’ না-বলতে থাকার বাস্তবতাতে সংক্ষোভ হিসাবে। সুমন সম্ভবত সেই প্রবণতার বাইরে থাকবার সংকল্প থেকেই কাজ শুরু করেন; আর শুরু করেন তাঁর পছন্দের চলচ্চিত্রীয় প্রবণতাগুলোকে কমবেশি ‘লালন’ করার আগাম-ডিজাইন থেকে। খুব বিচিত্র না যে ছবিটা দেখতে থাকলেও তাঁর সেই সংকল্প ও চলচ্চিত্র-ডিজাইনটা ধরা পড়ে যেটা আমি খুব প্রশংসন হিসাবে উল্লেখ করছি না আসলে।

ছবিটাতে গল্পরেখা, আরও সূক্ষ্মভাবে বললে গল্পসূত্র, আসলে মোটের উপর তিনটা: ‘কৃষিজ’ গ্রামীণ ‘মজুর’ জীবনের দুঃসহ দারিদ্র্য ও নিরুপায়ত্ব; সন্তানহারা মায়ের নিবিড় স্থানচ্যুত বাৎসল্য; অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ অবধারিত দারিদ্র্যজনিত বিচ্ছেদ। এর কোনোটাই অর্থোডক্স পর্যালোচনায় যাকে ‘সাবপ্লট’ বলে তার বৈশিষ্ট্যের সূচক নয়। বরং, সংশ্লেষিত সমান্তরালে চলমান সূত্র। এর শেষোক্তটা, নিরুপায় বিচ্ছেদ, অন্তত আমার জন্য/প্রতি/কাছে, নিজগুণে এত হৃদয়স্পর্শী মর্মন্তুদ যে ঢাকার প্রায় যেকোনো প্রলেতারীয়কে কিছুক্ষণের জন্য সংলাপে পেলেই আমার বুক ফাঁপতে থাকে এই প্রশ্নে যে তিনি কি ‘আপনজনের’ সাথে আছেন? দূরে আছেন? শিগগির যাবেন? যেতে ইচ্ছা করে? রাতের বাসের ছাদে যান? কতদিন পর যান? মধ্যবিত্তীয় ও নগরাঞ্চলীয় সাংস্কৃতিক ক্রিয়াদিতে এসব নগর‘শ্রমিক’দের অ-নগর জীবনের মায়ামমতামণ্ডিত জীবনের প্রতি সংবেদ কিংবা সংবাদ কোনোটারই বিশেষ হদিশ মেলে না। বস্তুত, এগুলো সাংস্কৃতিক কাজকর্মে মোটের উপর অনুপস্থিত। যে বা যারা অল্পবিস্তর দৃকপাত করেছেন, তাঁরা এগুলোকে সস্তা/গ্রস দুঃখময়তা/সেন্টিমেন্টালিটি ও ভোটকা/মেগা সাফল্যের দলিল বানান। বিচিত্র নয় যে সেসব প্রচেষ্টদের বড় অংশই উন্নয়নসংস্থার সাথে সম্পর্কিত; সেসব প্রডাক্টকে আমার একান্ত বান্ধবেরা ‘এনজিও লিটেরেচার বা চলচ্চিত্র’ নামও দিয়েছেন।

সেই কারণেই আরও বিশেষভাবে সুমনের (বা মুহাম্মদ কাইউমের) উদ্যোগগুলোর স্বতন্ত্র গুরুত্ব আছে। তা স্বতন্ত্র গুরুত্ব দিয়ে পাঠ করতে হবে। প্রডাক্ট হিসাবে সিনেমাটা নিয়ে যেমন, যাত্রাপথ হিসাবে সিনেমা নির্মাণ প্রক্রিয়া নিয়েও। অন্তত আমার এই বিবেচনা।

এই ধরনের সূক্ষ্ম অথচ স্পষ্ট, উপেক্ষিত অথচ হকিকতীয়, প্রসঙ্গে ছায়াছবিতে নির্মাতার নন্দন-ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা অদরকারি ছিল। বিশেষত, সেই চেষ্টাগুলো নন্দনের পাশাপাশি (আমার কাছে) ধরা পড়েছে বলে। একাধিক জায়গায় ছবিটা তথাকথিত ‘ডকুমেন্টারি’র প্রচলিত ভিজ্যুয়ালে থেকেছে। সত্যি বলতে, সেটাকে নির্মাতার দারুণ সাহস হিসাবে দেখি আমি, বিশেষত তাঁর নন্দননিষ্ঠা আমি টের পাচ্ছি বলে। ‘গ্রামীণ’ বাজারদৃশ্য, কিংবা ঢাকার সড়কদৃশ্যে ক্যামেরার অধিষ্ঠান, দৃশ্যগতি, দৃষ্টিতল কোনো কিছু নিয়েই তিনি দুশ্চিন্তা করেননি। কিন্তু তিনিই আবার মাতৃস্নেহ/বাৎসল্য দেখাতে গিয়ে অহেতু শ্লথগতি আর ডিটেইলস-দেখানোর-আগ্রহে বাস্তবে কাঁচা/অমসৃণ দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। কোনো ছায়াছবির পাঠদানে এই জায়গাগুলো একটা একটা করে দেখালে নবীন চিত্রপ্রেমীরা আগ্রহ পেতে পারেন; যদি কখনও সেরকম পরিস্থিতি হয়, তাই-ই করব।

আমার বিচারে, লাইট ডিজাইন আর ‘স্থানীয় ভাষায়’ অভিনয় করানো এই দুটো চাপ নির্মাতা এমনভাবে সারাটা ছবি জুড়ে বহন করেছেন যে ছবিটা নির্মাতার এই চেষ্টা-জনিত-ক্লান্তির কিছুটা ছবির দৃশ্যেও নিয়ে এসেছে। ‘স্থানীয় ভাষা’তে ছায়াছবি দুর্দান্ত একটা চ্যালেঞ্জ। তবে আমার কোনো ডগম্যা নেই। যদি গ্যালিলিও বা রাজা ইদিপাস ২০২৩ এর বাংলাদেশে বসে দেড়শ বছর আগের মাইকেলীয় লিখিত বাংলায় কথা বলে আমাদের নাড়া দিতে পারেন, তাহলে ভাষার প্রশ্নটা ‘বাস্তবতাবাদী’ নির্মাতারা আরেকবার ভেবে দেখতে পারেন। অন্তত, ‘খাঁটিভাষা’র চেষ্টা যদি অভিনয়কে দুবলা করে দিতে থাকে, তাহলে আমি সুপারিশ করব অভিনয়ে মনোযোগ দিতে, এবং ‘খাঁটি স্থানীয়ভাষা’র দুশ্চিন্তা বাদ দিতে। এই সঙ্কট এই ছবিতে বেশ প্রকট; কখনো কখনো মনখারাপ হবার মতো। অভিনেতাদের এর সাপেক্ষে ওর তুলনা করব না আজ। সাধারণভাবে অভিনয়-আউটলেটের কথাই বলছি। ‘ফজলু’কে (ফজলুল হক) দেখে উপরন্তু মনে হয়েছে, অনেকবার, তিনি জানেন যে তিনি একটা ‘দুখী’ মানুষের রূপায়ন করছেন। ছবিতে চরিত্রসমূহ যত কম এগুলো মনে রাখবেন ততই দর্শকের জন্য সেই দুঃখানুভূতিতে পৌঁছানো সহজ হতে থাকবে।

ছবির সাউন্ড ডিজাইন খুব ভাল। এতে করে মুখ্যত আবহসঙ্গীতের কথা বললাম। আবহ-সঙ্গীতকারের সত্যজিতীয় সঙ্গীতের প্রতি (সম্ভাব্য) প্রীতির কারণে, এবং একুইস্টিকের জায়গায় সিন্থাসাইজারে বেহালাবাদনের উদ্যোগ গ্রহণের কারণে কিছু জায়গা ঢ্যাবসা হয়ে যাওয়া বাদ দিলে আসলেই ভাল শব্দনকশা। এই ভাল সাউন্ড ডিজাইন কয়েক জায়গায় নন্দনপ্রবণ চিত্রায়ন/সিনেমাটোগ্রাফির সাথে বেশ আলাদা যুগলবন্দিও তৈরি করেছে। মূল ছবির কিছু কাঁচামি/ঢিলামি না থাকলে সেগুলো আরও আকর্ষণীয় অনুভূত হতো। স্থানীয়/লোক-গীতির বাছাই মনকাড়া। তবে, বলাই বাহুল্য, এগুলোর মধ্যে নাগরিক কণ্ঠে ও স্টুডিও রেকর্ডিংয়ে গৃহীতগুলো তুলনামূলক ভোঁতা, অনাকর্ষণীয় ও মুডে-অমিশ্রিত।

ছবিটার কাঁচামির একটা বড় জায়গা ছবির প্রপস/অনুষঙ্গ দ্রব্যাদি ও প্রাণিকুল। জীবিত প্রাণিকে ‘প্রপস’ বলা অপাশবিক হচ্ছে হয়তো, আমি অত ভাষা মনে করতে পারছি না। স্থানীয় উচ্চারণ চেষ্টা ও অনুষঙ্গের অভাব এই দুই-ই দুর্বলতার মেরিটলিস্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। একটা মরা-গরুর অভাব, কিংবা জীবিত গরুর মরা অভিনয় করতে আপত্তি গরুর মৃত্যুদৃশ্যটিকে এতটা বিশ্বাস-অযোগ্য বানিয়েছে যে বেদনাটি দর্শকের মধ্যে সঞ্চারিত হয় দর্শকের নিজের চেষ্টাতে, ছবির প্রদত্ত ক্লু-তে নয়। এমনিতেই গোয়ালঘরে (গ্রামে তো বটেই) বাতি-থাকা ছবির দর্শকদের জন্য যতটা আরামদায়ক, গরুজাতির জন্য ততটাই বেদনাদায়ক ঘুমহরণকারী। কাউকে দিয়ে একটা অন্তত সুইচ অন করানো এই কাতর (সম্ভাব্য) দৃশ্যটির সূচনার জন্য জরুরি ছিল। তবে তাতেও গরুহীন গরুর মৃত্যু চ্যালেঞ্জিং। যে বাছুরটি এত গুরুত্বপূর্ণ গল্পসূত্রে, প্রায় অনুভূতি-নির্ধারণী, তিনি হাজির হন প্রায় ছবি আধাঘণ্টা দর্শকে দেখে ফেলার পর। পরে আন্দাজ করা গেল যে তিনি যেহেতু ছবির কাল অনুযায়ী বিশেষ ছোটবড় হতে পারবেন না, তাই একে সন্তর্পণে আনা হয়েছে। খুব বিনয় করে বললেও, সদ্যোজাত, অভিকর্ষ-সামলাতে চঞ্চল, মাতৃহারা এক বাছুরের প্রতি পুতুলের মায়া/টান না হয় নির্দেশক বলে দিচ্ছেন; যদি দর্শকেরও ‘মায়া’ টানতে হয়, তাহলে ওরকম একজন বাছুরকে অবশ্যই রাজি করানো দরকার ছিল কাস্ট হতে। ছোট গরু দিয়ে (এবং অনুপস্থিতি দিয়ে) প্রাথমিক কালের বাছুরের কাজ চালানো এই ছায়াছবির প্রতি অত্যাচার হয়েছে।

টেকনিক্যালিটি দারুণ গল্পের মন্দ পরিণতি আনতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে যখন ছবি দেখানোর বন্দোবস্তই এত সীমিত, তখন আমার আলাপ প্রায় ধান ভানতে শিবের গীতের মতো।

গল্পটি মর্মন্তুদ, অথচ অতিশয় পরিচিত (অন্তত হবার কথা)। সত্যিই যখন নগরের রিকশাচালক ফজলু রাতের খাবার প্লেটের সামনে বসে কথা বলছে পুতুলের সাথে, আর দুজনই এই বিচ্ছেদে অবসন্ন বেদনার্ত, তখন বুক হু-হু করা ছাড়া বিশেষ উপায় থাকে না। তখন যদি ফজলু পরিপাটি দাওয়াইতে বসে না খেতেন, বরং ঢাকার রিকশাগ্যারেজের নৈমিত্তিক হাতে-থালা ভিড়ভাট্টা পদ্ধতিতেই খেতেন, কোনো সমস্যা হতো না; বরং এই ভিড়ের মধ্যে আড়াল করে আপনজনের সাথে আড়াই মিনিটের ‘দাম্পত্য’ আরও দাগ কাটতে পারত। যদি ফজলু বন্ধকী জমি ছাড়ানোর কারণ পুনর্বার পুতুলকে নাও বলত, কেবল শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত আর বলত ‘একদিন দেখিস আমরা একত্রেই থাকব’, তাতেও দর্শকের কান্না না চেপে পারত না।

সামাজিক বেদনাপ্রবাহের ছবিগল্প বানানির জন্য সংলাপের মিনিমালিটি এবং ননচ্যালান্ট অভিনয় সম্ভবত একটা শক্তিশালী পদ্ধতি।

লেখক: মানস চৌধুরী

অধ্যাপক, নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।