প্রথমেই হোচট খেলাম প্রবেশ করতে গিয়ে! নাটক শুরুর সময় ছিল সন্ধ্যা সাতটা। ছয়টা আটান্ন মিনিটে গিয়ে দেখি প্রবেশ পথের কলাপসিবল গেট বন্ধ! জানা গেল সাড়ে সাতটায় গেট খোলা হবে। দেরীর সঠিক কারণটা জানা গেল না। আমন্ত্রণ পত্রে কোনো অতিথির নাম ছিল না। তাই ভেবেছিলাম অতিথির জন্য অনুষ্ঠান শুরু করতে সচরাচর যে বিলম্ব ঘটে সেই সম্ভাবনা নেই। তা ছাড়া একজন অভিজ্ঞ নাটকের মানুষের নাটক প্রদর্শনী, এখানে হয়তো সময় জ্ঞানটা মেনে চলা হবে। তাই সঠিক সময়ে নাটক দেখার অনেক প্রত্যাশা নিয়ে সময় মতোই হাজির হয়েছিলাম। কিন্তু অন্যান্য আয়োজনের মতো এখানেও হতাশ হলাম!
দ্বিতীয় বার ধাক্কা খেলাম মিলনায়তনে প্রবেশ করে। ঘোষক ঘোষণা দিলেন নাটক শুরু হবে আরো পনেরো মিনিট পরে! তবে এবার ঘোষকের ঘোষণায় একটু আঁচ পাওয়া গেল যে, আছে, আছে, অতিথি আছে! তারা আসছেন! অবশেষে তারা এলেন। এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট বিলম্বের কারণ ষ্পষ্ট করে ঘোষণা না দিয়ে বা এ জন্য কোনো ক্ষমা প্রার্থনা বা দুঃখ প্রকাশ না করেই নাটক শুরু হলো। আবারও হতাশা!
যাক্ গে এসব। নাটকের কথায় আসি। 'চিরায়ত বাংলা নাটক' এ বিষয়টিকে সামনে রেখে মিলনায়তন পরিপূর্ণ দর্শক নিয়ে গাইবান্ধার খ্যাতিমান নাট্যকার তুলসী লাহিড়ী’র কালজয়ী নাটক "ছেঁড়া তার" ১৭ অক্টোবর ২০২৩ মঞ্চস্থ হলো গাইবান্ধা জেলা শিল্পকলা একাডেমি'র ব্যবস্থাপনায়।
নাটকটি নির্মাণে ছিল নির্মাতার অত্যন্ত দক্ষতা এবং আন্তরিকতার ছোঁয়া। তিনি তার সাধ্যমতো চেষ্টা এবং চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করেছেন নাটকটির গল্প এবং প্রতিটি চরিত্র অত্যন্ত বাস্তব ভাবে দর্শকের মানসপটে ফুটিয়ে তোলার জন্য এবং তিনি সফল হয়েছেন। যদিও কোনো কোনো অভিনেতার ক্ষেত্রে বা দৃশ্যে কিছুটা ব্যর্থতা লক্ষ্য করা গেছে কিন্তু সেই ব্যর্থতায় নির্দেশকের ভূমিকার চেয়ে অভিনেতার ভূমিকাটাই আমার কাছে মুখ্য মনে হয়েছে। কেননা, একজন নির্দেশক শুধু তার সাধ্যমতো দিলেই হবে না, অভিনেতারও তা নেওয়ার বা ধারণ করার ক্ষমতা থাকতে হয়।
কয়েকটি চরিত্র নিয়ে কথা না বললেই নয়। নাটকের মূল চরিত্রগুলোর মধ্যে হাকিম উদ্দিন চরিত্রে মঞ্চে ছিলেন শামীম খন্দকার। তার কাছ থেকে যতোটা আশা করেছিলাম তার চেয়ে তিনি অনেকটা ভালো করেছেন। বলা যেতে পারে এ চরিত্রটিতে তিনি সফলতার সাক্ষর রেখেছেন। তবে তার কন্ঠস্বর মাঝে মাঝে এতোটাই নিচে নেমে গেছে যে, পিছনের দর্শকের কাছে তা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। যেহেতু আমি একেবারে পিছনের সারির দর্শক ছিলাম তাই বিষয়টি আমি অনুভব করেছি। একজন শিল্পীর কন্ঠস্বর পৌঁছাবে একেবারে শেষ সারির দর্শকের কাছে এটিই লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। রহিম উদ্দিন চরিত্রে শাহরিয়ার শমিত অনবদ্য অভিনয় উপহার দিয়েছেন। চরিত্রের সাথে নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছেন সহজেই। তার অভিনয়ে তেমন একটা ঘাটতি চোখে পড়েনি। রহিম উদ্দিনের স্ত্রী ফুলজান চরিত্রে মিষ্টি শাহরিয়ার যথেষ্ঠ চেষ্টা করেছেন নিজেকে ফুলজান তৈরি করতে। কিন্তু পুরোপুরি না হলেও হতাশ করেন নি। তবে তার কন্ঠের ব্যাপারে তার আরো যত্নশীল হওয়া দরকার। কন্ঠের কারণে অভিব্যক্তি এবং অনুভুতি প্রকাশে তিনি কিছুটা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে তার চেষ্টাটা ছিল প্রচন্ড! নজরে পড়ার মতো চরিত্র ছিল কুকড়া। এ চরিত্রে মঞ্চে দেখা গেছে রেজাউল করিম মুন্নাকে। মুন্না দর্শকদের হতাশ করেন নি। ষ্পষ্ট আঞ্চলিক উচ্চারণ, অঙ্গভঙ্গি সব মিলিয়ে চরিত্রটিকে বাস্তবতায় রুপ দিয়ে দর্শককে আনন্দ দিয়েছেন। কানা ফকিরের কথা না বললেই নয়। অতি অল্প সময় মঞ্চে অবস্থান করে দর্শকদের নজর কেড়েছেন ময়নুল হোসেন। তার সংলাপ উচ্চাণের ঢং ছিল সত্যিই প্রশংসার। তবে ঐ সময়ে তার সহঅভিনেতাদের 'অতি' অভিনয়ে তার দিক থেকে দর্শকের মনোযোগ বিঘ্নিত হয়েছে। নাটকের অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে ২/১ জনের আঞ্চলিক ভাষা উচ্চারণে সমস্যা বা ভাষার মিশ্রণের কথা বাদ দিলে সবাই চমৎকার করেছেন। যার যার জায়গা থেকে সাধ্য মতো চেষ্টা করছেন তার চরিত্রকে উপস্থাপন করতে। একটা কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে- নাটকের শেষ দৃশ্যে রহিম উদ্দিনের ফাঁসির দৃশ্যটায় রহিম উদ্দিনকে ওভাবে টেনে উপরে তোলাটা না দেখিয়ে সরাসরি ঝুলন্ত দেখালে বোধহয় ভালো হতো।
নাটকটিতে একটি সুন্দর ও শক্তিশালী 'টিমওয়ার্ক' ছিল এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। খাইরুল বাশার এবং জগন্নাথ চক্রবর্তীর সেট ডিজাইন ছিল অত্যন্ত চমৎকার এবং সময়োপযোগী। এহ্তেশামুল হক অন্তর আলোকসজ্জায় যথেষ্ঠ দক্ষ ও যত্নবান ছিলেন তা আলোক সম্পাতে প্রমানিত হয়েছে। নূরুল ইসলাম ও ওমর আল সানি'র নেপথ্য সঙ্গীত দর্শকদের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। বিশেষ করে সারিন্দার সুর!
নাটকের নির্দেশক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও পরিবেশনা বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মেহেদী তানজির। তিনি তার মেধা, মনন আর দক্ষতা দিয়ে "ছেঁড়া তার"এর মতো একটি বাস্তবধর্মী নাটককে অত্যন্ত সফল ভাবে মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন। নাটকে বিশ্বযুদ্ধের দৃশ্য গুলো পর্দায় দেখানো কাহিনীকে আরো হৃদয়গ্রাহী ও পরিপূর্ণ করেছে, যোগ করেছে অন্য মাত্রা। তার বক্তব্যে জানা যায় নাটকটি নির্মাণে তিনি মাত্র এক মাস সময় পেয়েছেন। বলা বাহুল্য যে, "ছেঁড়া তার"এর মতো একটি নাটক নির্মাণে এ সময় একেবারেই কম। কিন্তু তিনি তার কর্তব্যে এতটুকুন অবহেলা আর দায়িত্ব কোনো ছাড় দেননি বলেই এ স্বল্প সময়ে এমন একটি সুন্দর প্রযোজনা গাইবান্ধার দর্শকরা দেখতে পেলেন। তবে নাটকটিকে সংক্ষিপ্ত করার ক্ষেত্রে আরো একটু মনোযোগি হলে গল্পের ধারাবাহিকতা বুঝতে দর্শকদের আরেকটু সুবিধা হতো। নাটকের ব্যাপ্তিকাল আর ১৫/২০ মিনিট বাড়ালে বোধহয় মন্দ হতো না।
নতুনত্ব ছিল রহিম উদ্দিনের কুলখানি বা চল্লিশা খাওয়ানোর আয়োজন। মিলনায়তন ভর্তি দর্শকের প্রত্যেকের হাতে যখন উত্তরবঙ্গের, বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার "আটার ডাইল" এর প্লেট চলে এলো তখন আর হতাশ নয়, সব দর্শকের মতো আমিও হতবাক হলাম! মনে পড়ে গেল বহুদিন আগে গাইবান্ধায় দর্শনীর বিনিময়ে আবৃত্তির অনুষ্ঠানে ভাঁপা পিঠা খাওয়ানোর কথা। তবে আমার জানা মতে গাইবান্ধায় নাটকের দর্শকদের এই প্রথম কোনো নাটকের প্রদর্শনীতে খাওয়ানো হলো।
একটি চমৎকার প্রযোজনা উপহার দেওয়ার জন্য জেলা শিল্পকলা একাডেমিকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
লেখক: শাহ আলম বাবলু
নাট্যকার