শিরোনাম
অনলাইনে কুতথ্য প্রতিরোধে সফল ভূমিকা রাখছে আইইডি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন নিত্যপণ্যের দাম কমানো, রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবিতে গাইবান্ধায় বাম জোটের বিক্ষোভ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জরুরী পদক্ষেপের দাবি বাম জোটের জ্বালানি খাতে এখনই ৪০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব খাওয়ার স্যালাইনের সহ-উদ্ভাবক বাংলাদেশের বন্ধু রিচার্ড ক্যাশ মৃত্যু বরণ করেছেন বিসিএস পরীক্ষা দেওয়া যাবে তিনবার  কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে পদত্যাগের আলটিমেটাম  বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত টাকা ফেরাতে  আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক সহযোগিতায় রাজি শোষণ-বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক জাগরণ যাত্রার ডাক সিপিবি’র

শতবর্ষ পেরিয়ে ‌‘মুল্লুকে চলো আন্দোলন’

শরিফ উল আনোয়ার সজ্জন


শতবর্ষ পেরিয়ে ‌‘মুল্লুকে চলো আন্দোলন’

২০ মে, ২০২২ চা শ্রমিকদের ‌‘মুল্লুকে চলো আন্দোলন’ এর ১০১ বছর। ১৯২১ সালের এই দিনে ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক নিজেদের জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার কালে চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটে গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয় শত শত চা শ্রমিকদের। মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় শ্রমিকদের মৃতদেহ। ২০ মে তেই ইতিহাসে যুক্ত হয় শাসক শ্রেণি কর্তৃক শ্রমজীবী মানুষকে পৈশাচিক ভাবে হত্যার একটি ঘৃণ্যতম ঘটনার। শত শত চা শ্রমিককে হত্যা করে লাশ মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। শ্রমিকদের রক্তে লাল হয়ে উঠে মেঘনার জল।

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না। ওলন্দাজ বণিকরা ১৬১০ সালে প্রথম চীন থেকে ইউরোপে চা আমদানি শুরু করে। ইংরেজরাও চা আমদানি করতো চীন থেকে। চীন জাপান যুদ্ধের কারণে চীনের সাথে সম্পর্ক অবনতি হলে আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজরা চা উৎপাদনের বিকল্প হিসেবে ভারতবর্ষের উপর নজর দেয়। ১৮৩৫ সালে বিজ্ঞানীদের নিয়ে ‘রয়েল সোসাইটি’ নামে একটি কমিশন গঠন করে ভারতবর্ষে চা উৎপাদনের সম্ভাব্যতা অনুসন্ধান শুরু করে। এই কমিটি কাজ শুরু করার আগেই শিলচর এবং করিমগঞ্জে চা গাছের সন্ধান পাওয়ায় ঐ বছরই প্রথম চীনের বাইরে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। ১৮৩৮ সালে সিলেট ও কাছাড়ে পরীক্ষামূলকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়।

১৮৫৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগানে চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। চা-শিল্প মূলত একটি শ্রমঘন শিল্প। চা-শিল্পের বিস্তারের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় শ্রমিক সংকট।

ব্রিটিশ মালিকরা দালাল নিয়োগ করে মিথ্যা প্রলোভন, উন্নত জীবন ও আজীবন কাজের আশ্বাস দিয়ে গিরমিট প্রথায় (বন্ধকী চুক্তি)তে জাহাজ ভর্তি করে বিহারের ছোট নাগপুর, উড়িষ্যা, অন্ধ প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, বাকুড়া  থেকে দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষ পীড়িত সাঁওতাল, লোহার, কুর্মী, মুন্ডা, কুলবিল, কানু, তেলেগু, রবিদাস, গোয়ালাসহ প্রায় ১১৬টি জাতিগোষ্ঠীর চাষীদেরকে চা শ্রমিক হিসেবে সংগ্রহ করে। জাহাজে গাঁদাগাঁদি করে আসাম পর্যন্ত আসার পথেই অনাহারে মারা যেত অর্ধেক মানুষ। এরপর তাদেরকে নিয়ে আসা হয় আসামে তাদের জন্য নির্ধারিত এলাকায়। এখন যেখানে সবুজ সুন্দর চা বাগান, সেখানে তখন ছিল বিস্তীর্ণ জঙ্গল। এই জঙ্গলে ছিল হিংস্র পশু-পাখি আর পোকামাকড়। শ্রমিকদের প্রাথমিক কাজ ছিল এই ভয়ংকর জঙ্গল পরিষ্কার করে চা বাগানের উপযোগী করা। একদিকে ভয়ংকর জঙ্গল, হিংস্র জন্তু-জানোয়ার, অর্ধাহার, অনাহার, রোগ-শোক অন্যদিকে ইংরেজদের অমানবিক আচরণ। দ্রুতই এইসব অসহায় মানুষদের স্বপ্ন ফিকে হয়ে যেতে থাকে। মরতে থাকে তারা গণহারে।

সরকারি এক হিসেবে দেখা যায়, ১৮৬৩-১৮৬৬ মাত্র তিন বছরে যে ৮৪ হাজার ৯১৫ জন শ্রমিক আমদানি করা হয়েছিল তার মধ্যে অনাহারে, অর্ধাহারে, অসুখে-বিসুখে ৩১ হাজার ৮৭৬ জন মারা যায়।

শ্রমিকদের এমনভাবে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল যাতে তারা ফিরে যাওয়ার কোনো পথ খুঁজে না পায়। অনাহার, অর্ধাহার, রোগব্যাধিসহ নির্যাতন-নিপীড়নে শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ ও অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। কোম্পানির লোকের চাবুক ও বুটের লাথি তাদের জীবন নরক করে তুলেছিল। মজুরি এতই কম ছিল যে তাতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার কোনো উপায়ই ছিল না। তখন পুরুষ শ্রমিকের হাজিরা ছিল চার আনা, নারী শ্রমিকের তিন আনা ও শিশুদের দুই আনা। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও একবেলার খাবার জুটতো না। যার ফলে অনাহার অর্ধাহারে জীবন পার করতো শ্রমিকরা। একদিকে খাবার সঙ্কট, বাসস্থান সঙ্কট অন্যদিকে বাগান মালিকদের নির্যাতন-নিপীড়নে অতিষ্ট চা শ্রমিকরা ব্রিটিশ মালিকদের শোষণ-বঞ্চনা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসতে থাকে। ‘গাছ হিলেগা, রুপিয়া মিলেগা’ এমন প্রলোভনে শ্রমিকরা বাংলাদেশে এলেও তাদের ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি।

 

এরকম একটা সময়ে ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন থেকে সমগ্র ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। আন্দোলনের খবর পায় চা শ্রমিকরাও। ১৯২০ সালে শ্রমিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বাগান থেকে বাগানে। মৌলভী আব্দুল করিমের সভাপতিত্বে সুরমা উপত্যকায় ব্রিটিশ মালিকদের অন্যায় অত্যাচার জুলুমের বিরুদ্ধে, তাদের সকল রকম ব্যবসাসহ চা বাগান বয়কটের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় চা বাগানের মালিকরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করলেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ায়নি।

এই পটভূমিতে চা বাগানের দুর্বিষহ জীবনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে ১৯২১ সালে চা শ্রমিকদের ‘মুল্লুক চল’ অভিযানের মধ্য দিয়ে। ১৯২১ সালে ৩ মার্চ সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জের প্রায় ত্রিশ হাজার চা শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাগান ছেড়ে নিজ মুল্লুকে ফিরে যাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে। ‘মুল্লুক চল’ অর্থাৎ নিজ ভূমিতে চল। শ্রমিকরা দাবি তুলে ছিল ‘ইংরেজদের অধীনে কাজ করবে না, নিজ ভূমিতে ফিরে যাবে।’ কাছাড়ের লক্ষ্মীপুরের গঙ্গাদয়াল দীক্ষিত ও তাঁর দুই সহযোগী দেওশরণ ত্রিপাঠী ও রামপ্রসাদ চৌবের নেতৃত্বে ‘মুল্লুক চল’ অভিযান শুরু হয়।

জন্মভূমি যাবার পথ তাদের জানা ছিল না। শুধু এটুকু ধারনা ছিল চাঁদপুর থেকে স্টিমারে করে যাওয়া যায় কলকাতা।

কাছাড় ও সিলেটের শ্রমিকরা দলে দলে চা বাগান ত্যাগ করে যাত্রা শুরু করে। তাদের গন্তব্য চাঁদপুর, সেখান থেকে ষ্টিমারে গোয়ালন্দ হয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া। শ্রমিকদের আটকাতে মালিকরা রেলকর্তৃপক্ষকে তাদের ট্রেনের টিকেট না দেওয়ার নির্দেশ দেয়। সিলেট, বরমচাল, কুলাউড়া, শমসেরনগর, শ্রীমঙ্গল, সাতগাঁও, শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশনে শত শত শ্রমিক জড়ো হয়। টিকেট না পেয়ে শ্রমিক ও পরিবারের সদস্য মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ রেল লাইন ধরে পায়ে হেঁটে চাঁদপুর পৌঁছে। পথে খাদ্যের অভাব ও অসুখে মারা যার অনেক শিশু ও নারী।

এদিকে বাগান মালিকরা সরকারের সহযোগিতায় শ্রমিকদের পথরোধ করতে চাঁদপুরে মোতায়েন করে আসাম রাইফলেস এর গুর্খা সৈন্য। শ্রমিকরাও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারা দাসত্বের এ শৃঙ্খল ছিন্ন করে নিজ মুল্লুকে পৌঁছুবেই। আজীবন এই গিরমিট প্রথায় আবদ্ধ থাকতে চায় না। শ্রমিকরা স্টিমারে উঠতে চাইলে গুর্খা সৈন্যের বাঁধার সম্মুখীন হয়। শ্রমিকদের এ বিদ্রোহ দমন করতে গুর্খা সৈন্যরা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে।

ছত্রভঙ্গ হয়ে হাজার হাজার চা শ্রমিক চাঁদপুর রেলস্টেশনে জড়ো হয়ে প্লাটফর্মেই অবস্থান নেয়। ১৯২১ সালের ২০ মে কমিশনার কিরণ চন্দ্র দে, ম্যাজেস্টেট সুশীল সিংহ, চা-কর সাহেব ফার্গুসনের উপস্থিতে রাঁতের আধারে ঘুমন্ত শ্রমিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র গুর্খা সৈনিকরা। শত শত শ্রমিক হতাহত হয়।

২০ মে তেই ইতিহাসে যুক্ত হয় শাসক শ্রেণি কর্তৃক শ্রমজীবী মানুষকে পৈশাচিক ভাবে হত্যার একটি ঘৃণ্যতম ঘটনার। শত শত চা শ্রমিককে হত্যা করে লাশ মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। শ্রমিকদের রক্তে লাল হয়ে উঠে মেঘনার জল।

এই মর্মান্তিক ঘটনা সারা ভারতবর্ষকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। চা শ্রমিকদের সমর্থনে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তারা এক মাসের ধর্মঘট করে। তাদের সাথে যোগ দেয় স্টিমার কোম্পানীর শ্রমিক-কর্মচারীরা। চা-শ্রমিকদের সহায়তার জন্য চাঁদপুরের কংগ্রেস নেতা বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী হরদয়াল নাগের নেতৃত্বে গঠিত ত্রাণ কমিটির আহ্বানে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার ‘মানি অর্ডারে’ অর্থ সাহায্য আসে। দুই হাজার তরুণের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে ওঠে। সকল সতর্কতার পরেও ত্রাণকেন্দ্রে কলেরা মহামারি দেখা দিলে শত শত চা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্য মৃত্যুবরণ করে।

চা শ্রমিকদের অনড় অবস্থান, রেল ও স্টিমার শ্রমিকদের দীর্ঘ ধর্মঘট, দেশব্যাপী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কঠিন লড়াইয়ে ফলশ্রুতিতে চা বাগানের ব্রিটিশ মালিকরা চা শ্রমিকদের সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়। মালিক ও প্রশাসনের প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে যারা বাগানে ফিরে যেতে চাইলেন তারা বাগানে ফিরে গেলেন। আর যারা নিজ দেশে ফিরতে চাইলেন তাদেরকে প্রশাসনের সহযোগিতায় সেখান থেকেই নিজ মুল্লুকে ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়া হয়।

এ ভাবেই পরিণতি পায় হাজার হাজার শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত একটি লড়াই। চা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এদিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ন্যায়সঙ্গত অনুপ্রেরণা হয়ে।