পাভেল পার্থ'র কলাম

গীদিতা রেমার কথা মনে আছে?

গীদিতা রেমার কথা মনে আছে?

ভূমি আন্দোলনের ইতিহাসে নারীর লড়াইকে বারবার পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। অথচ হুল কী টংক আন্দোলন থেকে শুরু করে চলমান ভুমি অধিকারের আন্দোলন সবই পুরুষতান্ত্রিক ভূমি দখলের বিরুদ্ধে নারীর লড়াই। টংক আন্দোলনে রাশিমনি হাজং, কুমুদিনী হাজং; তেভাগা আন্দোলনে ইলা মিত্র; ভানুবিল আন্দোলনে লীলাবতী সিংহ; ঘুঘুদহ আন্দোলনে জায়েদা; চিংড়ী ঘের বিরোধী আন্দোলনে করুনাময়ী সর্দার কিংবা টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনের গীদিতা রেমা সবাই ভূমি অধিকার আন্দোলনের সংগ্রামী উত্তরাধিকার।

টাঙ্গাইলের মধুপুরের শালবন এলাকার এক আদিবাসী গ্রাম মাগন্তিনগর। এই গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই এক মান্দি কৃষক পরিবারে জন্ম নেন গীদিতা রেমা। গীদিতার মায়ের নাম দীপালি রেমা, বাবা গনেশ রিছিল (পাগলা)। মধুপুর থেকে পঁচিশমাইল নেমে বা টেলকি থেকে ভেতরে মাগনতিনগর গেলে এখন দেখা যায় একদার মান্দি গ্রামটিতে আজ বাঙালিদেরই আধিক্য। এদের সবাই বাইরে থেকে এসে এখানে বসতি গেড়েছেন। এখন এই গ্রামে আনারস বাগানের এলাকাও কমে কলার বাগানে পরিণত হয়েছে। মাতৃসূত্রীয় মান্দি সমাজে নিজস্ব জুম-জমিন ভাগ বাটোয়ারার ক্ষেত্রে, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে, পরিবারে মেয়েদের, বিশেষত ছোট মেয়েদের প্রাধান্য দেয়া হয়। সেই রীতিতে গীদিতাদের জমিনের অনেকটাই পায় গীদিতার ছোট বোন নম্রতা রেমা। আর এই জমির লোভেই এলাকার ওঠতি ভূমিসন্ত্রাসী মফিজ গং নম্রতা রেমাকে অপহরণ করে। বেশকিছু দিন তাকে আটকে রেখে জোর করে বিয়ে করে ও ধর্মান্তরিত করে। কিন্তু একমাস যেতে না যেতেই নম্রতা মফিজের বন্দিদশা থেকে পালিয়ে মাগন্তিনগর তাদের বাড়িতে চলে আসে। মফিজের ভয়ে নম্রতাকে অন্য জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয। মফিজ বাঙালি ব্যাটাগিরি ফলাতে ২০০১ এর ২০ মার্চ সশস্ত্র হামলা করে গীদিতাদের বাড়ি। নম্রতাকে না পেয়ে গীদিতার ছোট বোন ইতালিন রেমাকে জোর করে অপহরণ করতে চাইলে, গীদিতা বাঁধা দেয়। ধারালো অস্ত্র নিয়ে মফিজ গং গীদিতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। খুন হয় গীদিতা। মফিজ গং পালায়। গীদিতার বোন কবিতা রেমা বাদী হয়ে মধুপুর থানায় খুনীদের নাম উল্লেখ করে মামলা করে। আসামীরা কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছে, মধুপুর এলাকায় এখনও তারা বুক টাটিয়ে ঘুড়ে বেড়ায়। গীদিতা রেমা হত্যার ন্যায়বিচার হয়নি এবং গীদিতার পরিবার এক জমাট বিচারহীনতার জ্বালা বয়ে চলেছেন দীর্ঘ বিশ বছর।

টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবন পৃথিবীর এক প্রাচীন পত্রঝরা অরণ্য। ১৯৫০ সনে প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত শালবন হয়ে যায় ‘রাষ্ট্রীয় বনভূমি’।  ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খানের আমলে মান্দিদের উচ্ছেদের জন্য ‘জাতীয় উদ্যান’ নাম দিয়ে ২০,৮২৭.৩৭ একর শালবনে তারের বেড়া দেয়া হয়। ১৯৭৭-৭৮ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য বনবিভাগ দখলকৃত ‘সংরক্ষিত বন এলাকায়’ করা হয় বম্বিং রেঞ্জ। ১৯৮২ সনে ‘আটিয়া অধ্যাদেশের’ মাধ্যমে টাঙ্গাইল জেলার ৫৫,৪৭৬.৩৮ একর ভূমি ‘আটিয়া সংরক্ষিত বন’ হিসেবে ঘোষিত হয়। এর ভেতরেই মান্তি গ্রাম উচ্ছেদ করে প্রাকৃতিক শালবনে তৈরি হয় বিমান বাহিনীর ফায়ারিং ও বোম্বিং রেঞ্জ। ১৯৮৪ সনে মধুপুর বনে বসবাসরত মান্দি-কোচদের বনবিভাগ আবার উচ্ছেদ নোটিস দেয়। ১৯৮৯-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণের টাকায় টিএনডিপি’র সাড়ে সাত হাজার একর উডলট ও এগ্রোফরেষ্ট্রি বাগান করার ফলে অনেক মান্দিরা আপন জায়গা জমিন হারায়। ২০০০ সন থেকেই শালবনের ৩০০০ একর কোর এলাকাকে ৬১,০০০ রানিং ফুট দেয়াল দিয়ে ঘিরে বিতর্কিত ‘ইকোট্যুরিজম প্রকল্প’ শুরু হয়। ২০০৪ সনের ৩ জানুয়ারি ইকোপার্কবিরোধী মিছিলে বনরক্ষী ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয় পীরেন স্নাল। ২০১৬ সনে আবারো অরণখোলা মৌজার ৯১৪৫.০৭ একর ভূমিকে আবারো সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। আর শুধু এই মৌজাতেই আছে কয়েকশত বছরের প্রাচীন ১৩টি মান্দি গ্রাম।

২০০৭ সনে দখলকৃত বনভূমি ‘উদ্ধারের’ নামে একের পর এক কলাবাগান কেটে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। বনবিভাগ মোড়ে মোড়ে সাইনবোর্ড টানায় ‘কলাচাষ পরিবেশ ধ্বংস করে’। ২০২০ সনের ১৪ সেপ্টেম্বর পেগামারি গ্রামের বাসন্তী রেমা ও গেটিস যেত্রা পরিবারের ৫০ শতক জমির পাঁচ শতাধিক শবরী কলা গাছ কেটে ফেলে বনবিভাগ।

প্রাকৃতিক বনভূমি ও আদিবাসীদের ভেতর এক গভীর মিল রয়েছে। উভয়ের সংখ্যাই দিনে দিনে কমছে। উভয়েই উন্নয়নের বিপদজনক নিশানা। কারণ অরণ্য ও আদিবাসী জীবন একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেড ২০১৭ থেকে ২০১৮ মধুপুরের ৪৪টি গ্রামের ১১ হাজার ৪৮ পরিবারের ওপর একটি জরিপ করে। দেখা যায়, ৪৪টি গ্রামে মান্দি ও বাঙালি মিলিয়ে জনসংখ্যা ৪৭ হাজার ৭২৬। এর ভেতর ৬৪.৬১ শতাংশ বাঙালি এবং মান্দি ৩৫.৩৯ শতাংশ। ১৯৫১ সনের জনশুমারী অনুযায়ী মধুপুরের অরণখোলা ইউনিয়নের জনসংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৮০০ জন এবং এদের প্রায় সকলেই ছিলেন মান্দি ও কিছু কোচ জনগোষ্ঠী। ২০১৭ সনে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের এক সুবিশাল জরিপে দেখা যায়, অরণখোলা, আউশনারা ও শোলাকুড়ি ইউনিয়নে ১২৬টি গ্রামের ভেতর আদিবাসী গ্রাম ৪৯ এবং বাঙালি গ্রাম ৭৭। বনবিভাগ ঘোষিত সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর আদিবাসীদের ১৬২৮.২৬ একর চালা এবং ৪৪৭.২৭ একর নামা জমি মিলিয়ে মোট ২০৭৫.৫৩ একর জমি পড়েছে। সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর ৫৬৫৯ জন আদিবাসী এবং ৩০০৩ জন বাঙালির বসতভিটা ও কৃষিজমি পড়েছে। বনবিভাগের করপোরেট উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বারবার পৃথিবীর এক আদি অরণ্য আর এই অরণ্যসভ্যতার জনগণ আত্মপরিচয়ের পত্রপল্লব হারাচ্ছে প্রতিদিন। প্রাচীন মাংরুদামের বাস্তুতন্ত্র ও স্মৃতি বিনষ্ট করে আরবোরেটাম গড়ে তোলা কিংবা দোখোলা বনের ভেতর লেক খনন করা এরকম কাজ এখনো চলছে।

কেবল গীদিতা রেমা নয়. মধুপুরে বনবিভাগ খুন করেছিল বিহেন নকরেককে। বাঙালি বলপ্রয়োগে খুন হন অধীর দফো, নিন্তনাথ হাদিমা, সেন্টু নকরেক। বনবিভাগ ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল শিশিলিয়া স্নালের শরীর। গীদিতা রেমা কর্পোরেট দুনিয়ার পুরুষালি বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধেই ঘোষণা করেছিলেন তার দ্রোহী অস্তিত্ব। মান্দি সমাজের আদিশিক্ষা জংগল, ভূমি কখনোই মানুষের অত্যাচারে খুন হতে দেয়া যায়না। জংগল মাটির লগে পূর্বজনদের বিশ্বাস ও স্মৃতি মিশে থাকে। গীদিতা বহিরাগত বাঙালির বলপ্রয়োগ থেকে সেই জংগল জন্মমাটির অস্তিত্ব রক্ষা করতে চেয়েছেন জান দিয়ে। বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলন, ভূমি আন্দোলন, অরণ্যসংগ্রাম কী জনবিপ্লবে সব কালে সব প্রান্তেই নারীর জোরালো আওয়াজ ও স্বাক্ষর আছে। পুরুষতান্ত্রিক ইতিহাসগ্রন্থনের কায়দা বারবার এ চিহ্ন গায়েব করে দেয়। আর এ কারণেই হয়তোবা গীদিতা রেমা হত্যার ন্যায়বিচার এখনো নিশ্চিত করতে পারিনি আমরা।

পাভেল পার্থ

লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: [email protected]