রাজতন্ত্র, অস্ট্রেলিয়া ও আধুনিক বিশ্ব

পলাশ বসাক


রাজতন্ত্র, অস্ট্রেলিয়া ও আধুনিক বিশ্ব

রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ-এর মৃত্যুতে গ্রেট ব্রিটেনে টানা দশ দিনের শোক চলছে। রাণীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান ‘অপারেশন লন্ডন ব্রিজ’-এর অংশ হিসেবে জাতীয় প্রচার মাধ্যমগুলোতে উপস্থাপকেরা কালো পোষাক পরছেন আর সেই সাথে বন্ধ আছে প্রায় অন্য সব ধরণের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানাদি। অন্যান্য আরো অনেক প্রটকলের মধ্যে নতুন রাজা চার্লসের অভিষেক হচ্ছে। এসব আয়োজনে খরচ হচ্ছে কয়েক বিলিয়ন ডলার।

রাণী’র মৃত্যুর প্রভাব অস্ট্রেলিয়াতেও পরেছে। এখানেও টানা শোক চলছে কেননা রাণীই ছিলেন এ দেশের রাষ্ট্র প্রধান। গ্রেট ব্রিটেনের সাথে তাল মিলিয়ে এদেশে রাণীর জন্য শোক এবং নতুন রাজার অভিষেকের আয়োজন ঘটা করে পালিত হচ্ছে। বিশেষ বিবেচনায় একদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াতে। সরকারী এবং বিরোধী দল সমানতালে এসব আয়োজনে সামিল হচ্ছে।

তবে শুধু অস্ট্রেলিয়াতে নয়, রাণী সব মিলিয়ে পনেরটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। সেসব দেশেই এমন আয়োজন চলছে। সেই সাথে কমনওয়েলথভূক্ত দেশগুলো শোক পালন করছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান-সহ নানা দেশে রাস্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।

এসব ঘটনার ডামাডোলে আমি ভাবছিলাম আমরা কি সত্যিই একবিংশ শতাব্দিতে আছি নাকি আছি কয়েকশ বছর আগে? শুধুমাত্র উত্তরাধিকার সূত্রে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার প্রথা বা রাজতন্ত্র কি আধুনিক বিশ্ব মডেল-এর সাথে সাংঘর্ষিক নয়?

আজ সকালে ডাটা সাইন্টিস্টের হ্যাট পরে কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখলাম। দেখতে পেলাম এখনো বিশ্বের দশটি দেশের মধ্যে প্রায় দুটিতে (২২% দেশে) রাজতন্ত্র বহাল আছে। শাসন ব্যবস্থায় রাজ পরিবারগুলোর প্রভাবে পার্থক্য থাকলেও, বিশ্বে সব মিলিয়ে ৪৩ টি দেশের রাস্ট্র প্রধান একজন রাজা বা রাণী। গ্রেট ব্রিটেন, স্পেন, নেদারল্যান্ড-সহ ইউরোপের ১২টি; জাপান, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড-সহ এশিয়ার ১৩ টি; ক্যানাডা-সহ আমেরিকার ৯টি; অস্ট্রেলিয়া-সহ ওশেনিয়ার ৬টি; এবং আফ্রিকার ৩টি দেশে চলছে রাজতন্ত্র।

তবে পুরোপুরি রাজতন্ত্র (Absolute monarchy) আছে মাত্র ৫টি দেশে (সৌদি আরব, ওমান, ব্রুনেই,  ইসোয়াতিনি বা সোয়াজিল্যান্ড, এবং ভ্যাটিকান সিটি)। প্রায় ৩০টি দেশে আছে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র (Constitutional monarchy)। এসব দেশে নির্বাচিত সরকার থাকে কিন্তু বস্তুত সর্বেসর্বা রাজপরিবার। গ্রেট ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা বা জাপানে এই ধরণের রাজতন্ত্রই বহাল আছে।

রাজতন্ত্র আছে এমন দেশগুলোতে সব মিলিয়ে জনসংখ্যা ৬০২ মিলিয়ন। অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় ৭.৫ শতাংশ মানুষ রাজতন্ত্রের অধীনে বসবাস করে। কিন্তু মজার বিষয় হলো বিশ্ব আয়ের প্রায় ২০% এই দেশগুলোতে যায়। রাজতন্ত্র-ভিত্তিক দেশগুলোর মোট জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রায় ২১ ট্রিলিয়ান ডলার। এর মধ্যে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে আছে এক তৃতীয়াংশ, প্রায় ৭.৭ ট্রিলিয়ান ডলারের অর্থনীতি (১৫ দেশ মিলিয়ে)। রাজপরিবারগুলো বসে বসে রয়েলটি বা এসব পয়সার ভাগ পান!

ফোর্বস-এর হিসেব অনুযায়ী ২০২১ সালে বৃটিশ রাজপরিবারের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে রাণী এলিজাবেথের ব্যক্তিগত সম্পদ ছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলার।

আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত দেশ গ্রেট ব্রিটেনে, অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা, বা জাপানে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা ঠিক কি সেটা বোধগম্য হয় না। অস্ট্রেলিয়াতে এ বিষয়ে গণভোট হয়েছিল ১৯৯৯ সালে গনভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু দেশের বেশীরভাগ জনগন রাজতন্ত্রের অধীনে থাকাই পছন্দ করেছে! অবশ্য যেসব দেশে সরাসরি রাজতন্ত্র নেই সেখানে কি পরিবারতন্ত্র নেই?

গত প্রায় সাত বছর অস্ট্রেলিয়াতে আছি। এখানকার টাকা-পয়সায় রাণীর ছবি দেখে অভ্যস্ত হয়েছি। রাণীর জন্মদিন উপলক্ষে সাধারণ ছুটি উপভোগ করেছি। তাই রাণীমাতার মৃত্যুতে শোক জানাই!

 

পলাশ বসাক

সিডনি, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২