শিরোনাম
নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী ধ্রুবব্রত দাস ধ্রুব’র অস্বাভাবিক মৃত্যুর সঠিক তদন্তের দাবিতে মানববন্ধন অনলাইনে কুতথ্য প্রতিরোধে সফল ভূমিকা রাখছে আইইডি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন নিত্যপণ্যের দাম কমানো, রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবিতে গাইবান্ধায় বাম জোটের বিক্ষোভ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জরুরী পদক্ষেপের দাবি বাম জোটের জ্বালানি খাতে এখনই ৪০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব খাওয়ার স্যালাইনের সহ-উদ্ভাবক বাংলাদেশের বন্ধু রিচার্ড ক্যাশ মৃত্যু বরণ করেছেন বিসিএস পরীক্ষা দেওয়া যাবে তিনবার  কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে পদত্যাগের আলটিমেটাম  বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত টাকা ফেরাতে  আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক সহযোগিতায় রাজি

সাংবাদিকতার পথে অনুপ্রেরণা, দ্বিধা ও বাস্তবতা

এক মৃত্যু আমাকে সাংবাদিকতা করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল, আরেক মৃত্যু আমাকে ভাবাচ্ছে—আমি কি ভুল পথে এলাম?


সাংবাদিকতার পথে অনুপ্রেরণা, দ্বিধা ও বাস্তবতা

শিতাংশু ভৌমিক অংকুর,
এক মৃত্যু আমাকে সাংবাদিকতা করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল, আরেক মৃত্যু আমাকে ভাবাচ্ছে—আমি কি ভুল পথে এলাম? ফরিদপুর ব্যুরো প্রধান হিসাবে কর্মরত ছিলেন শহীদ গৌতম দাস। তিনি আমার সাংবাদিকতা পেশা বেছে নেওয়ার মূলকাণ্ডারী। অনেকে হয়তো তাকে চিনেন না, আবার অনেকে হয়তো চিনেন। কিন্তু আজ প্রবীণ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের চলে যাওয়া এবং তার শেষ লেখা আমাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

সাংবাদিকতা কেবল তথ্য প্রকাশ নয়; এটি সাহস, দায়িত্ব, এবং প্রায়শই নিজের নিরাপত্তার বিপরীত ঝুঁকি নেয়ার নাম। বুকে অসীম সাহস আর মাঠে দৌড়াদৌড়ির দিন একদিন শেষ হবে। দুপুরের খাবার না খেয়ে রাতের খাবার খাওয়া, অল্প বেতনে চলা—এই জীবনধারা দীর্ঘমেয়াদে টানা সম্ভব নয়। একদিন প্রিয়তমার পরিবার জিজ্ঞেস করবে—“ছেলে, তুমি কি করে, কোথায় থাকো? তোমার লাইফ সিকিউরিটি কী?” তখন প্রিয়তম হয়তো বলবে, “আমার কোন লাইফ সিকিউরিটি নেই।” তখন তার বাবা নিশ্চয় ভাববেন, তার কন্যার জন্য এমন জীবন নেওয়া ঠিক নয়। সাংবাদিকতার পথের অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি মাঝে মাঝে আমাকে দ্বিধায় ফেলে।

চাকরি আর সাংবাদিকতা এক নয়—এই কথা ছোটবেলায় শুনেছিলাম ফরিদপুরে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হওয়া গৌতম দাসের কাছ থেকে। সাংবাদিকতা মানে ক্ষমতার নিচে পিষ্ট মানুষের কথা বলা, তা তাঁর জীবন থেকেই শিক্ষা নিয়েছি। আমি প্রায় আট বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত, সেই সময়কাল আমার জীবনে নানা চ্যালেঞ্জ, অভিজ্ঞতা এবং অনুপ্রেরণার সমন্বয় ঘটিয়েছে।


ফরিদপুরে সাংবাদিকতার যাত্রা

আমার সাংবাদিকতা জীবনের সূচনা হয় ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে পড়ার সময়। তখন স্থানীয় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় মাসে তিন হাজার টাকা বেতনে রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করি। সেই বেতন আমার কাছে অনেক মূল্যবান ছিল। তখনকার জীবন কঠিন ছিল—ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের হামলার শিকার হয়ে পড়া এবং পড়াশোনা ছেড়ে বাসায় ফিরতে হয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা আমাকে জীবনের ঝুঁকি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন করেছিল।

ফরিদপুরে আসার পর সুদেব চক্রবর্তীর আশ্রয় পেয়েছি। তার মাধ্যমে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে। তবে রাজনীতির প্রতি টান তখনও তেমন ছিল না। বরং সাংবাদিকতার স্বপ্ন আমাকে টেনে নিয়ে চলছিল। গৌতম দাসের জীবন ও কথা ধীরে ধীরে আমার জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।

সাধারণ জীবনের পাশাপাশি অর্থকষ্টও ছিল। তবে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। সুদেব চক্রবর্তী দাদা তার এনজিও এসডিসির নতুন প্রজেক্টে আমাকে যুক্ত করলেন। কিছু মাস সেখানে কাজ করার পরও মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল সাংবাদিকতার স্বপ্ন।

শাপলা সড়কের সমকাল অফিসে প্রথম পরিচয় হলো জেলা প্রতিনিধি হাসানুজ্জামান হাসানের সঙ্গে। আমি তখন বলেছিলাম, “দাদা, আমি সাংবাদিকতা করতে চাই।” হাসান ভাই হেসে বললেন, “ভালো তো কর।” সুদেব দাদা যোগ করলেন, “সাংবাদিক করবি কর, কিন্তু চ্যাচড়া হোস না।” তখন পুরোপুরি বুঝতে পারিনি কথাটার গভীরতা।

পরবর্তীতে শরীয়তপুর ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি সাইফ রুদাদের কাছে আমার ইচ্ছা প্রকাশ করি। তিনি আমাকে বিনা বেতনে একটি স্থানীয় অনলাইন মিডিয়ায় লেখার সুযোগ দিলেন।

ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি শেখ ফয়েজ আহমেদের সঙ্গে পরিচয়ের পর তিনি আমাকে ফরিদপুর এক্সপ্রেস ও সাপ্তাহিক একটি পত্রিকায় কাজের সুযোগ দিলেন। বেতন ঠিক হলো তিন হাজার টাকা। এটিই প্রথমবার বেতনের বিনিময়ে সাংবাদিকতা করা।


সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ ও কঠিন বাস্তবতা

এরপর বাংলাদেশ সমাচার ও দ্যা বাংলাদেশ ডায়েরির বিশেষ প্রতিবেদক হলাম। পড়াশোনা, রাজনীতি ও একাধিক পত্রিকার কাজ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারি পদে দায়িত্ব নেওয়ার সময় করোনা ভাইরাসের লকডাউনের আগে ফয়েজ আহমেদ প্রদত্ত দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হলো। তখন মাসে দুই হাজার টাকা এবং পত্রিকা বিক্রি থেকে প্রায় ৩০০ টাকা আয় করেই চলতাম।

সাংবাদিকতা আমার কাছে কেবল একটি পেশা নয়, এটি ছিল জীবনের প্রতিশ্রুতি। অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ছিল, তবে সত্য বলার প্রতিশ্রুতি সবকিছুর ওপরে। রাতের সময় বিভিন্ন সংবাদ সংগ্রহ করতে হতো। কখনও কখনও শারীরিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে হতো। প্রশাসন, ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতাদের চাপ মোকাবিলা করতে হতো। এই চাপ ও ঝুঁকি সাংবাদিকতার অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা।


ছাত্র রাজনীতি থেকে সরিয়ে সাংবাদিকতার দিকে

ছাত্র ইউনিয়নের ভাঙন এবং সিপিবির প্রভাব আমাকে দ্বিধায় ফেলেছিল। গৌতম দাস প্রায়শই বলতেন, “ক্ষমতার নিচে পিষ্ট মানুষের কথা বলাই সাংবাদিকতা।” সেই কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে বিদ্রোহ করলেও দ্বন্দ্ব ও চাপ বেড়ে যায়। আমাকে সভাপতি করার দাবি উঠলেও স্থানীয় সিপিবির নেতারা বাধা দেন। কেন্দ্রীয় বিভেদের কারণ ফরিদপুরে দুইটি কমিটি তৈরি হয়।
কাউন্সিলের মধ্যদিয়ে একটি সিপিবির নেতাদের ইচ্ছায় আরেকটি। ওই  কাউন্সিল থেকে বের  করে দেওয়া কর্মী ও কাউন্সিলরদের ভোটে আমাকে সভাপতি করা হয়।
কিন্তু আমার সহযোদ্ধাদের সম্মানেই আমি সেদিন দায়িত্ব নিয়েছিলাম। তবে দ্বন্দ্ব আমাকে ছাত্র রাজনীতি থেকে বিমুখ করে। সিদ্ধান্ত নিলাম, রাজনীতি নয়, সাংবাদিকতার মাধ্যমে আদর্শ প্রকাশ করব।


ঢাকায় সাংবাদিকতার অধ্যায়

ঢাকায় এসে কবি নজরুল সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হলাম। তখন যোগ দিলাম ঢাকা ওয়েভ নামক অনলাইন নিউজ পোর্টালে মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার হিসেবে, মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতনে।

পরবর্তীতে দৈনিক কালবেলায় ক্যাম্পাস রিপোর্টার পদে যুক্ত হলাম। একবার ছাত্রলীগের হাতে ফুটেজ তুলতে গিয়ে নির্মমভাবে মার খেতে হয়। তবু থেমে যাইনি। কালবেলায় একের পর এক সংবাদ প্রকাশ করেছি। সবসময় চেষ্টা করেছি ক্ষমতার নিচে পিষ্ট মানুষের কণ্ঠ তুলে ধরতে।

বেতন নগণ্য, সংবাদ সংগ্রহের খরচ বেশি। রিপোর্টার পদে উন্নতি হলেও বেতন বাড়েনি। পরিবর্তন আসে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকার হাজার ছাত্র-জনতা-পুলিশের লাশের বিনিময়ে পতন ঘটে। তখন আর কালবেলায় কাজ করতে ইচ্ছে হয় না। মনোযোগী হলাম ক্যাম্পাসে নতুন সাংবাদিক তৈরির কাজে।

কবি নজরুল সরকারি কলেজ সাংবাদিক সমিতির ভেতরে নানা অনিয়ম চোখে পড়ে। কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে নারী হয়রানি ও চাঁদাবাজি। প্রতিবাদ করায় আমাকে টার্গেট বানানো হয়। আমাকে ‘বাম’, ‘শাহবাগী’ নামে আখ্যা দেওয়া হয়। হলে সিট বাতিল করে দেওয়া হয়, রুমে ভাঙচুর হয়।

এরপর যোগ দিলাম দেশকাল নিউজ ডটকমে, আগের তুলনায় কম বেতনে। তবু কাজ চালিয়ে গেলাম। সাংবাদিকতা ছাড়ার কথা ভাবিনি।


দ্বিধা, প্রতিশ্রুতি এবং সাংবাদিকতার বাস্তবতা

এ পুরো পথচলায় বারবার মনে হয়েছে—আমি কি ভুল করেছি? পরিবার, প্রিয়জন, সমাজ—সবাই চায় স্থায়ী নিরাপদ জীবন। সাংবাদিকতার মধ্যে সেই নিরাপত্তা কোথায়? গৌতম দাসের মৃত্যু আমাকে সাহসী করেছিল, বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু আমাকে ভীত করছে। তবে আমি জানি, চেষ্টা না করলে থেমে থাকা সম্ভব নয়।

সাংবাদিকতা মানে সত্য বলা। সত্য বলা কখনো সহজ নয়। বেতন নগণ্য, ঝুঁকি বিপুল, কিন্তু ক্ষমতার নিচে পিষ্ট মানুষের কণ্ঠ তুলে ধরা—এটাই আসল সাংবাদিকতা। প্রায় আট বছরের দীর্ঘ সাংবাদিকতা অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে—প্রত্যেক নিউজ, প্রতিবেদন এবং অনুসন্ধান মানুষকে শক্তি ও সচেতনতা দিতে পারে।

লেখক:সংবাদকর্মী