শিরোনাম
নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী ধ্রুবব্রত দাস ধ্রুব’র অস্বাভাবিক মৃত্যুর সঠিক তদন্তের দাবিতে মানববন্ধন অনলাইনে কুতথ্য প্রতিরোধে সফল ভূমিকা রাখছে আইইডি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন নিত্যপণ্যের দাম কমানো, রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবিতে গাইবান্ধায় বাম জোটের বিক্ষোভ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জরুরী পদক্ষেপের দাবি বাম জোটের জ্বালানি খাতে এখনই ৪০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব খাওয়ার স্যালাইনের সহ-উদ্ভাবক বাংলাদেশের বন্ধু রিচার্ড ক্যাশ মৃত্যু বরণ করেছেন বিসিএস পরীক্ষা দেওয়া যাবে তিনবার  কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে পদত্যাগের আলটিমেটাম  বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত টাকা ফেরাতে  আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক সহযোগিতায় রাজি

“তৃতীয় বিশ্বের সন্তান: বাবা-মায়ের দায়বদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ গঠন”

“সীমিত সম্পদ, সামাজিক বাধা ও রাষ্ট্রীয় চ্যালেঞ্জের মধ্যেও সন্তানের সুস্থ ও নৈতিক গড়ে ওঠা নিশ্চিত করা বাবা-মায়ের মূল দায়িত্ব”


“তৃতীয় বিশ্বের সন্তান: বাবা-মায়ের দায়বদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ গঠন”

শিতাংশু ভৌমিক অংকুর, 

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পরিবারে সন্তান লালন–পালন করা একটি বিশেষ সংগ্রামের নাম। এখানে বাবা–মায়ের দায়িত্ব কেবল সন্তানকে বড় করা নয়, বরং নানা ঘাত–প্রতিঘাত, দারিদ্র্য, সামাজিক কুসংস্কার ও রাষ্ট্রীয় অস্থিরতার ভেতর দিয়ে তাকে মানুষ করে তোলা। উন্নত দেশের মতো এখানে সন্তান জন্ম নিলেই সরকারের সবধরনের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। ফলে প্রতিটি বাবা–মা হয়ে ওঠেন সন্তানের বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠা এবং ভবিষ্যৎ গঠনের মূল স্তম্ভ।প্রথমেই যে দায়িত্বটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো সন্তানের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। খাবার, আশ্রয়, চিকিৎসা ও পরিচ্ছন্নতা—এগুলোই শিশুর প্রথম অধিকার। অথচ বাস্তবতায় দেখা যায়, বহু পরিবারই দারিদ্র্যের কারণে এই মৌলিক প্রয়োজনগুলোই পূরণ করতে পারে না। একবেলা খেয়ে আরেকবেলা না খাওয়া, সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থা, অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের দীর্ঘ সারি—এসবই প্রমাণ করে যে, বাবা–মায়ের কাঁধে এখানে দায়িত্ব বহুগুণ কঠিন। কিন্তু এই কঠিন বাস্তবতার মাঝেও সচেতন অভিভাবকরা সীমিত সম্পদকে সর্বোচ্চ কাজে লাগিয়ে সন্তানের সুস্থ বেড়ে ওঠার চেষ্টা করেন।এরপর আসে শিক্ষার প্রশ্ন। তৃতীয় বিশ্বের সমাজে শিক্ষাই হলো উন্নতির প্রধান সিঁড়ি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এখানেই সবচেয়ে বেশি বাধা আসে। অর্থের অভাবে অনেকে সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়, শিশুশ্রমে পাঠায় বা মেয়েশিশুর বিয়ে দিয়ে দেয় অল্প বয়সেই। অথচ শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির মুক্তি নেই। বাবা–মায়ের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হলো সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠানো, তার পড়াশোনায় আগ্রহ জাগানো এবং অন্তত মৌলিক শিক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া। শুধু ডিগ্রি অর্জনের জন্য নয়, বরং বাস্তব জীবনের দক্ষতা ও মানবিক বোধ গড়ে তোলার মাধ্যম হিসেবেই শিক্ষাকে দেখতে হবে।শিক্ষার পাশাপাশি সমান গুরুত্ব পায় নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা। একটি সন্তান পরিবার থেকেই শিখে নেয় সততা, ন্যায়–অন্যায়, সহমর্মিতা কিংবা দায়িত্ববোধ। তৃতীয় বিশ্বের সমাজে যেখানে দুর্নীতি, বৈষম্য, সহিংসতা আর কুসংস্কার প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, সেখানে বাবা–মায়ের কর্তব্য আরও বড় হয়ে যায়। সন্তান যাতে অন্যায়ের সাথে আপস না করে, দুর্নীতির পথে না যায় এবং সমাজে একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে, তার জন্য বাবা–মাকে ছোটবেলা থেকেই সঠিক শিক্ষা দিতে হয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ হোক বা মানবিকতা—সবকিছুর ভিত্তি বাবা–মায়ের হাতে গড়ে ওঠে।তবে শুধু নৈতিক শিক্ষা নয়, সন্তানের নিরাপত্তাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে, মাদক, যৌন নিপীড়ন কিংবা সাইবার হয়রানি—এসব বিপদ তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের জন্য ভয়াবহ বাস্তবতা। বাবা–মায়ের দায়িত্ব হলো সন্তানের দিকে সবসময় নজর রাখা, তাকে সঠিক বন্ধুত্ব ও নিরাপদ পরিবেশে বড় হতে সাহায্য করা। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে ডিজিটাল নিরাপত্তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যে পরিণত হয়েছে।এর পাশাপাশি আবেগিক যত্নও উপেক্ষা করা যায় না। অনেক সময় দেখা যায় বাবা–মা শুধু খাওয়ানো–পরানো ও পড়াশোনার দায়িত্বকেই যথেষ্ট মনে করেন। কিন্তু সন্তানের মনে যদি ভালোবাসা, সহানুভূতি ও বোঝাপড়ার পরিবেশ না থাকে, তবে সে মানসিকভাবে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। দারিদ্র্য বা কর্মব্যস্ততার কারণে বাবা–মা সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে না পারলেও সন্তানের আবেগিক বিকাশের জন্য সামান্য সময় দেওয়া অপরিহার্য। তাকে শোনা, তাকে বুঝতে চেষ্টা করা, তার স্বপ্নকে গুরুত্ব দেওয়া—এসবই বাবা–মায়ের মৌলিক কর্তব্য।সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনে বাবা–মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বড়। শুধু ভালো ফলাফল নয়, বরং তাকে আত্মনির্ভরশীল মানুষ হিসেবে তৈরি করাই আসল লক্ষ্য। তৃতীয় বিশ্বের প্রেক্ষাপটে যেখানে কর্মসংস্থানের সংকট তীব্র, সেখানে সন্তানকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে সে নিজের যোগ্যতায় সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। বাবা–মায়ের দায়িত্ব তাকে স্বপ্ন দেখতে শেখানো, কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য সঠিক পথে চালিত করাও সমান জরুরি।সবশেষে যে বিষয়টি বলা দরকার তা হলো—সন্তান কেবল পরিবারের জন্য নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যও একটি সম্পদ। বাবা–মায়ের কর্তব্য সন্তানকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যাতে সে সমাজে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে দাঁড়ায়। সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য বা হিংসাত্মক রাজনীতির বেড়াজালে না জড়িয়ে বরং মানবিক, গণতান্ত্রিক ও ইতিবাচক চেতনায় গড়ে ওঠা উচিত প্রতিটি সন্তানের।তৃতীয় বিশ্বের দেশে বাবা–মায়ের দায়িত্ব পালন সহজ নয়। সীমাবদ্ধতা, দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ঘাটতি—সব মিলিয়ে বাস্তবতা ভয়াবহ। তবুও বাবা–মায়ের দায়িত্ব এড়ানো যায় না। কারণ একটি প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার মাধ্যমেই সমাজ ও জাতির অগ্রগতি সম্ভব। রাষ্ট্র হয়তো সবসময় সহযোগিতা করবে না, সমাজও হয়তো পাশে দাঁড়াবে না, কিন্তু পরিবারই সন্তানের প্রথম বিদ্যালয়, আর বাবা–মাই তার প্রথম শিক্ষক।আজকের পৃথিবীতে একটি শিশু জন্ম নিলে তাকে মানুষ করার সংগ্রাম শুরু হয় বাবা–মায়ের হাত ধরে। সেই সংগ্রামে সঠিক দিকনির্দেশনা, সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার, ভালোবাসা ও সুরক্ষার মাধ্যমে সন্তানের জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে হবে। একটি শিশু যদি সুস্থ, শিক্ষিত, নৈতিক ও আত্মনির্ভর হয়ে বড় হয়, তবে কেবল পরিবার নয়, গোটা সমাজ তার সুফল ভোগ করবে।একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে—“একটি শিশু গড়ে তুলতে গোটা গ্রামের প্রয়োজন।” কিন্তু সেই গ্রামের শুরুটা হয় বাবা–মায়ের হাত ধরেই। তৃতীয় বিশ্বের কঠিন বাস্তবতায় এই কথাটিই আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।