শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিনঃ হাবীব ইমন

শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিনঃ  হাবীব ইমন

শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিন
এক. 

‘যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ/ যদি তুমি রুখে দাও, তবে তুমি বাংলাদেশ’। একটি স্লোগান মাত্র। কিন্তু প্রতিনিয়ত এ স্লোগানে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের নতুন অনুরণন অথবা জাগরণ ঘটছে। আমরাও তার সঙ্গে একমত পোষণ করি। নতুন প্রজন্ম জাগছে, এটা আমাদের কাছে একটি আশা, এই আশা জেগে থাকুক। যেখানে বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি শূন্যের কোঠায় চলে গেছে। ২০১৮ সালেও দেখেছি কিশোর শিক্ষার্থীদের বিদ্রোহ কিংবা আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা। সেই আন্দোলন আজ আবারও প্রোথিত হচ্ছে। আমাদের সেই শিক্ষার্থীরা হারিয়ে যায়নি। কিন্তু ওরা কেন আন্দোলন করছে, আন্দোলনে যৌক্তিকতা কী? আমরা দেখেছি, সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক শিক্ষার্থীকে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের অসহায়ত্ব আর অস্থিরতা বাড়ছেই। শিক্ষার্থীদের হতাশা, ক্ষোভ ও তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কর্তৃপক্ষের টনক নড়লেও স্থায়ীভাবে টনক কিন্তু নড়ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সড়ক নিরাপত্তাসড়ক নিরাপত্তা নিয়ে সঠিক জ্ঞান, সচেতনতা না থাকায় অনেক সময় দুর্ঘটনার শিকার হন শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। গণপরিবহনে নিয়ন্ত্রণ কার হাতে? সেই প্রশ্নটি আজ আবারও করছি।  

দুই.

হাফ বা অর্ধেক ভাড়া নিয়ে আন্দোলনটা দীর্ঘদিনের। ৫৭ বছর ধরে চলা একটি প্রথা—হাফ পাস। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ারও আগের। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর, এরপর সরকার বদলেছে অনেকবার। কিন্তু শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিয়ে চূড়ান্ত কোনো আইন কিংবা সিদ্ধান্ত—কোনোটাই আসেনি। ফলে স্বাধীনতার পূর্বে চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে এখনো। গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।

ইতিহাসে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাত ধরে আসে ১১ দফা দাবি। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (রাশেদ খান মেনন), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (বেগম মতিয়া চৌধুরী), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) আটজন ছাত্রনেতা সম্মিলিতভাবে গঠন করেন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।

তিন.

ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী লুৎফুন্নাহার ফুরকানের বাসা ঢাকার মিরপুরে। সেখান থেকে আজিমপুরে কলেজে যেতে তাকে এখন ভাড়া দিতে হয় ২৬ টাকা। বাসা থেকে মিরপুর-১ বাসস্ট্যান্ডে যেতে তার খরচ হয় আরও ২০ টাকা। অর্থাৎ কলেজে যাওয়া-আসায় এক দিনেই তাকে গুনতে হচ্ছে ৯২ টাকা। এই হিসাব বলছে, কলেজে পড়ার জন্য কেবল যাতায়াতেই লুৎফুন্নাহারের মাসে খরচ যাবে দুই হাজার টাকার বেশি। ডিজেলের দাম বাড়ার পর পুনর্নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী ওই পথের ভাড়া হয় ২১ টাকা, কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে ৫ টাকা বেশি আদায় করা হচ্ছে। লুৎফুন্নাহার জানান, আগে কলেজ যাওয়ার জন্য বাস ভাড়া ছিল ২০ টাকা, তখন ‘হাফ’ ভাড়া নেওয়ায় তাকে দিতে হতো ১০ টাকা। এখন বাসে আর হাফ ভাড়া নিচ্ছে না। 

তিনি বলেন, ‘হাফ ভাড়া দিলে উল্টো বাজে ব্যবহার করে। আগে আমার কলেজ যেতে আসতে ৬০ টাকা লাগত, এখন প্রায় একশ টাকা। এই সংকট লুৎফুন্নাহারের মতো কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর। বাস ভাড়া বাড়ার পর তাদের কারও কারও যাতায়াত ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আর সেটাই রাজধানীতে শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের কারণ। ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর পরিবহন মালিকদের চাপে সরকার বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ায়। এর পর থেকেই বাসে অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে শিক্ষার্থীরা।

সিটি করপোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর সেই আন্দোলন আরও গতি পায়। অতিসম্প্রতি রামপুরায় আরেক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। সব মিলিয়ে পথে পথে তাদের বিক্ষোভ-অবরোধে রাজধানী ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ইডেনছাত্রী লুৎফুন্নাহার ফুরকানের ভাষায়, ‘হাফ ভাড়া আমাদের অধিকার। অনেক আগে থেকেই এটা ছিল। তাহলে এখন নতুন করে কেন এটা মানা হবে না?’ কেবল ঢাকায় কেন হাফ ভাড়া হবে? সংকট তো পুরো দেশেই। 

২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনেও ‘হাফ’ ভাড়ার দাবিটি ছিল। বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর নিহত হওয়ার পর শুরু হওয়া সেই আন্দোলনে নয়টি দাবির সপ্তম দফায় বলা হয়েছিল, ‘শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’ শিক্ষার্থীদের ৯ দিন ধরে চলা ২০১৮ সালের আন্দোলনের পর প্রণয়ন হয় সড়ক পরিবহন আইন। কিন্তু সেখানেও ৯ দফা একটি অর্ধেক ভাড়াসংক্রান্ত দাবি উপেক্ষা করা হয়েছে।

চার. 

প্রায় সবাই তেলের দামের সঙ্গে ছাত্রদের হাফ পাসের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরছেন। কিন্তু তেলের দাম বাড়া-কমার সঙ্গে ছাত্রদের হাফ পাসের কোনো সম্পর্ক নেই, এটা ছাত্রদের অধিকার। ছাত্রদের কারও দয়া করুণার দরকার নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছাত্রদের নির্বিঘ্নে নিরাপদে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা। মৌলিক অধিকার হিসেবে শিক্ষা অর্জনের সব দায় রাষ্ট্রের, সরকারের। কেবল ভারত ও পাকিস্তান নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোতেও শিক্ষার্থীরা গণপরিবহনে ভাড়ার ক্ষেত্রে ছাড় পেয়ে আসছে। উন্নত দেশেও ছাত্রদের জন্য আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা আছে। বাসেই ছাত্ররা ফ্রি যাওয়া-আসা করে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। বাংলাদেশে কতিপয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালেয় সে সুযোগ সামান্য থাকলেও স্কুল-কলেজগুলোতে তা নেই। শাসকরা দেশে কেন সে ব্যবস্থা করতে পারেননি? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য এ ব্যবস্থা থাকলে স্কুল-কলেজের জন্য কেন থাকবে না? এটা সরকারের দ্বিমুখী নীতি। স্কুলে-কলেজে ছাত্রদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। সেটা যেহেতু তারা করতে পারেনি—সে ক্ষেত্রে পরিবহনে ছাত্রদের হাফ পাসের ব্যবস্থা করা সরকারের অবশ্যই কর্তব্য। এটা শিক্ষার্থীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন নয়, এটা তাদের অধিকার। শিক্ষাকে গুরুত্ব না দিয়ে শিক্ষার্থীদের পরিবহন মালিকদের মুখোমুখি করিয়ে দিয়ে একটা সংঘাতপূর্ণ অবস্থা তৈরি করেছেন। এ অবস্থার জন্য দায়ী সরকার। উন্নত দেশের হাত ধরে ফেলার, তাদের সমকক্ষ হওয়ার গল্প শোনাবেন কিন্তু তাদের মতো ব্যবস্থা করবেন না, তা তো হয় না।

ছাত্রদের দাবি সরকারের কাছে, মালিক সমিতির কাছে নয়। তাই তাদের এই ঘোষণা আমলে নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এবং ইতোমধ্যে ছাত্ররা এটি প্রত্যাখ্যান করেছে। মালিক সমিতি তাদের ঘোষণার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করেছে মাত্র। হাফ ভাড়া কার্যকরের ঘোষণা মালিক সমিতি নয়, সরকারের কাছ থেকে আসতে হবে এবং তাতে কোনো শর্ত জুড়ে দেওয়া চলবে না। এবং তা সারা দেশের জন্য অভিন্ন হতে হবে। মালিক সমিতিকে সামনে ঠেলে দিয়ে সরকার তার দায় এড়ানোর অপচেষ্টা করছে বলে মনে করেন নেতারা।

পাঁচ.

শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের শুরু থেকেই সড়কের এই হত্যাকাণ্ডকে ‘কাঠামোগত হত্যা’ বলে আখ্যায়িত করে আসছে। শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই সমস্যার মূলে আঘাত করার চেষ্টা করে এলেও সরকারের তল্পিবাহক কিছু গোষ্ঠী নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনকে পরিবহন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দেখানোর চেষ্টা করে আসছে। যে কাঠামোগত সংকট সড়কে মৃত্যুর মিছিল ত্বরান্বিত করছে তাকে পরিবর্তন করার যে দাবি শিক্ষার্থীদের পক্ষে উত্থাপিত হয়েছে, সেটি খুবই যৌক্তিক এবং প্রাসঙ্গিক। 

আমরা নিরাপদ সড়কের প্রশ্নে চালকদের অদক্ষতা ও খামখেয়ালির কথাই শুধু বলি। কার্যকর কোনো পদক্ষেপও নিচ্ছি না। যাত্রী কিংবা পথচারীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কথা বলি না। আমার ধারণা, এই সমস্যার সমাধানে সুশাসন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সুশাসন কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষেও সম্ভব নয়, যারা তাদের সন্তানকে আনা-নেওয়াতে মোটরসাইকেল বা গাড়ি অথবা রিকশা নিয়ে আসেন, তাদেরও সচেতনতা দরকার। 

লেখক : কবি, কলামিস্ট  ও যুব ইউনিয়ন নেতা