বাজেট প্রতিক্রিয়া

দরিদ্রদের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে: নাগরিক ঐক্য

জাতীয় বাজেট ২০২২-২০২৩


দরিদ্রদের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে: নাগরিক ঐক্য

এই সরকার বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেবে, এটা আমরা প্রত্যাশা করি না। করোনার মতো বিশেষ একটা সময় যখন একেবারে ভিন্ন চিন্তার ভিন্ন কাঠামোর বাজেট দেয়ার কথা ছিল, তখনও আমরা আগের সব বাজেটের গতানুগতিক ধারাবাহিকতাই দেখেছি।

বর্তমানে দেশ যখন সামষ্টিক অর্থনীতির একটা বড় ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে আছে, তখনও গতানুগতিকতার বাইরে আলাদা কিছু হয়নি। সরকারের চরম অপ্রতুল পদক্ষেপের কারণে করোনার অভিঘাত সামলে উঠতে পারেনি দেশ।

দেশের মূল্যস্ফীতি এখন সরকারের হিসাবের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। করোনার সময় দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গিয়েছিল দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ। অত্যন্ত উচ্চ মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্যের পরিস্থিতি আরও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

ওদিকে ডলারের বিপরীতে টাকা তার মূল্য হারাচ্ছে অতি দ্রুত, যাতে এই মূল্যস্ফীতি অদূর ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর পর্যায়ে যাবে। দেশে বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্যের চরম ঘাটতি ক্রমাগত বাড়ছে। প্রবাসী কর্মীদের রেমিট্যান্সে ভাটার টান দেখা যাচ্ছে।

এছাড়া প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের কারণে দেশের রিজার্ভ দ্রুত কমে যাচ্ছে।

ওদিকে বিদেশি ঋণনির্ভর কিছু প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে ঋণ পরিশোধ করা শুরু হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এটা আরও বাড়বে। অথচ সরকার ন্যায্য খরচের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ব্যয় করে একের পর এক বিদেশি ঋণনির্ভর অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিচ্ছে নিজেদের লুটপাটের সুবিধার জন্য।

এই অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে কয়েকটি বিলাসী পণ্যের ওপরে শুল্ক বাড়িয়ে সেগুলোর আমদানি নিরুৎসাহিত করার চাইতে বড় কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আবার ল্যাপটপ, স্মার্টফোনের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ওপরে শুল্ক বাড়ানো দেশের শিক্ষার্থী এবং তরুণদের শিক্ষা এবং ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

তাছাড়া রেফ্রিজারেটর/ফ্রিজ এবং এলপিজি সিলিন্ডারের মতো অত্যাবশ্যক পণ্য; এমনকি ট্রেন ভ্রমণের ওপর ভ্যাট আরোপ করে সাধারণ মানুষের জীবনে সংকট আরও বাড়ানো হচ্ছে।

টাকা পাচার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ বাজেটে নেই। এটা করা না গেলে কিছু পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে আমদানি কিছুটা কমিয়ে রিজার্ভ ঠিক রাখা যাবে না কোনোভাবেই।

এই মুহূর্তে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেই। সমস্যা হচ্ছে সরকার তো স্বীকারই করছে না যে মূল্যস্ফীতি এখন ১৫ শতাংশের কাছাকাছি।

 

চরম মূল্যস্ফীতির এই সময়ে জরুরি পদক্ষেপ হওয়ার কথা ছিল সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ অনেক বাড়ানো। কিন্তু সেটা হয়নি। এমনকি এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে ৫০০ কিংবা ৭৫০ টাকা ভাতার অংকও বাড়ানো হয়নি। দরিদ্র মানুষের টিকে থাকা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়বে সামনের দিনগুলোতে।

বরাবরের মতো পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল সরকার আয়করের ক্ষেত্রে কম উপার্জনের মানুষের চাপ তৈরি করছে। বাৎসরিক আয়ের করমুক্ত সীমা ৩ লাখ টাকা (অর্থাৎ মাসিক মাত্র ২৫ হাজার টাকা) বৃদ্ধি করা জরুরি ছিল অনেক আগেই। এটা এমনকি এবারও বাড়ানো হয়নি। শুধু মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলেও তো এই সীমা বাড়ার কথা।

সামান্য কর দিয়ে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনার জন্য প্রশ্নহীন সুযোগের প্রস্তাব করা হয়েছে। যে মানুষ বিদেশে টাকা পাচার করেছে সেটা ফিরিয়ে আনবেন, এমন আশা করা ভুল। কিন্তু সরকারের এই সুযোগ দেয়া প্রমাণ করে সরকার এসব লুটেরা পাচারকারীদের সঙ্গেই আছে।

বাজেটে ভর্তুকি খাতে রাখা হয়েছে ৮২ হাজার কোটি টাকা, যার বিরাট অংশ যাবে বিদ্যুৎ খাতে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে কিংবা কম সক্ষমতায় চালিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের হাতে ভর্তুকির নামে হাজার হাজার কোটি টাকা জনগণের অর্থ তুলে দেয়া হবে আগের বছরগুলোর মতো।

প্রাসঙ্গিক একটি সংবাদের প্রতিও আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ভারতে আদানি গ্রুপের তৈরি গোড্ডা কোল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ২৫ বছর মেয়াদে বিদ্যুৎ কিনে বাংলাদেশ এক লাখ কোটি টাকার বেশি শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ দেবে। এতে ন্যায্য ব্যয়ের প্রায় তিনগুণ বাজেটে তৈরি পদ্মা সেতুর মতো তিনটি সেতু তৈরি করা যাবে এই টাকা দিয়ে।

এমনকি আগস্টে বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পন্ন হওয়ার পর সঞ্চালন লাইনের অভাবে দেশে বিদ্যুৎ না আসলেও ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে এক ইউনিট বিদ্যুৎ না নিয়েও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ১২১৯ কোটি টাকা।

সরকারের লুটপাটের টাকার সংস্থান করতে সরকার এবার হাত বাড়িয়েছে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের দিকে। সার্বজনীন পেনশনের নামে মানুষের কাছ থেকে অতি দীর্ঘ মেয়াদে টাকা নিয়ে সেটার নয় ছয় শুরু হবে এই বছর থেকে।

এক কথায় বলা যায়, দেশের সমষ্টিক অর্থনীতির সংকট এবং ভারসাম্যহীনতার মধ্যে প্রণীত এই বাজেট কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। সম্প্রতি শ্রীলংকার চরম অর্থনৈতিক সংকটের উদাহরণ সামনে রেখেও সরকার সেখান থেকে মোটেও কিছু শেখেনি।