চরের মানুষে যাযাবর জীবন

চরের মানুষে যাযাবর জীবন

চর ও নদীভাঙা মানুষের সাজানো সংসার প্রতিবছর ভেঙে যায়। এ-চর ও-চরে, এর-ওর জমিতে ঘর বাঁধেন তাঁরা। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, অভাব আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তাঁদের জীবন পোকামাকড়ের চেয়েও বেশি অনিশ্চিত।

ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন রহিমা বেগম (৩৭)। ২২ বছরে ২৩ বার তাঁর সংসার গ্রাস করেছে ব্রহ্মপুত্র। রহিমা জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের রহমান আলীর মেয়ে। ২২ বছর আগে রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুরের দিনমজুর দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে রহিমার ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় বসতভিটা ভেঙে যায় ব্রহ্মপুত্রে। পরে অন্যের জমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেন। বারবার নদীভাঙনে সর্বস্বান্ত তাঁর পরিবার।

গত বছর বসতভিটা ব্রহ্মপুত্র নদে বিলীন হলে শংকর মাধবপুর বিলপাড়া চরে অন্যের জমিতে ঠাঁই নেন রহিমা-দেলোয়ার দম্পতি। তাঁদের দুই মেয়ে, এক ছেলে রয়েছেন। দেলোয়ার মাসে ১৫ দিন দিনমজুরের কাজ করেন। দিনে উপার্জন করেন ৩০০-৪০০ টাকা। বাকি ১৫ দিন নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরেন। এতে মাছ বিক্রি করে পান ১০০-১৫০ টাকা। তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে যায়।

বিবাহিত দুই মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ের সংসার ভেঙে গেছে। পরে বাবার বাড়ি ঠাঁই হয় তাঁর। এতে অভাবের সংসারে চাপ আরও বেড়েছে। ছোট ছেলে রাশেদুল হাফিজিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করলেও ঠিকমতো তার খরচ বহন করতে পারেন না। বাড়তি আয়ের আশায় দুটি গরু বর্গা নিয়ে পালন করছেন। কিন্তু কখন যেন বসতবাড়ি নদীতে ভেঙে যায় সেই দুশ্চিন্তা তাড়া করছে তাঁদের।

রহিমা বলেন, 'নদীভাঙায় আমগোরে সব শ্যাষ। খুব কষ্টে আছি। সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাই না।'

ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে অন্তত ৩০ বার বসতভিটা সরাতে হয়েছে বিলপাড়া চরের শতবর্ষী হাফিজুর রহমানের। কাগজে ১০ বিঘা জমি থাকলেও টিকে আছে ১১ শতক। বাকি জমি নদে। বৃদ্ধ হাফিজুর বলেন, ৩০ বার নদীভাঙনের শিকার হলেও সরকারি সহায়তা পাননি। বর্ষাকালে সবচেয়ে বেশি ভাঙন দেখা দেয়। বৈশাখ মাস থেকে শুরু হয়ে আশ্বিন ও কার্তিক মাস পর্যন্ত চলে ভাঙন।সম্প্রতি দুপুরে এক থালায় ছেলেকে নিয়ে পান্তা খেতে দেখা যায় নদীভাঙনের শিকার বিলপাড়ার রুহুল আমিনকে। তিনি বলেন, গত বছর তাঁর বাড়িভিটা নদে বিলীন হয়েছে। এর আগেও ভাঙনের শিকার হয়ে ২২ বার এ-চর থেকে ও-চরে ঠাঁই নিয়েছিলেন। গত ৯ মাস ধরে অন্যের এক টুকরো জমিতে পলিথিন আর পাটখড়ির তৈরি জরাজীর্ণ ঘরে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছেন।

সাজাই আনন্দ বাজার এলাকার ফরিদ মিয়ার ভাষ্য, এলাকার প্রধান সমস্যা নদীভাঙন। যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই ভঙ্গুর। উপজেলা সদরে যেতে নৌকাই একমাত্র ভরসা। ১২ মাসই তাঁদের কষ্ট। তাঁর মতো দুই শতাধিক পরিবার সাজাই মৌজায় জমি বন্ধক নিয়ে বসবাস করে।

নদীশাসন ও রাস্তাঘাট নির্মাণ হলে চরের মানুষের ভাগ্যের উন্নতি হবে বলে দাবি নদীভাঙনের শিকার বিলপাড়া চরের সাদু শেখের স্ত্রী মাজেদা খাতুনের। তিনি বলেন, 'নদী না ভাঙলেই আমগোর শান্তি।'

কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর বিলপাড়ার চরে বসবাস করেন সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য মিনারা খাতুন। তাঁর ভাষ্য, শংকর মাধবপুর এলাকাটি খুবই অবহেলিত। তিনি ইউপি সদস্য হওয়ার পর তেমন কিছু বরাদ্দ পাননি। অবহেলিত এলাকাটির দিকে সরকারের নজর বাড়ানো দরকার।

শংকর মাধবপুরের বিলপাড়া এলাকার আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, চরের মানুষের জন্য চিকিৎসাসেবা বলতে তেমন কিছু নেই। কাগুজে একটি ক্লিনিক থাকলেও নিজস্ব কোনো ঘর নেই। চরের প্রসূতি এবং মানুষ অসুস্থ হলে তাঁদের বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়ে।

কোদালকাটি ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির ছক্কুর ভাষ্য, তাঁর ইউনিয়নের ছয়টি গ্রাম পুরোপুরি নদীতে বিলীন। গ্রামগুলো হলো- শংকর মাধবপুর, সাজাই, মধ্য সাজাই, পাইকাণ্ডারীপাড়া, উত্তর কোদালকাটি ও বিলপাড়া। ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারিভাবে কোনো সহায়তা করা হয়নি জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, কখনোই নদী ভাঙনের বরাদ্দ পাননি।

 

ইউএনও অমিত চক্রবর্তী বলেন, নদীভাঙা মানুষের সহায়তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে। তালিকা করা হচ্ছে। যাতে কোনো অভিযোগ না আসে।

রাজীবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আজিজুর রহমান বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে নদী ভাঙা মানুষকে আর্থিক সহায়তা দিতে ৪৮ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এখনও তালিকা করা শুরু হয়নি। যাচাই-বাছাই করে বিতরণ করা হবে।