শিতাংশু ভৌমিক অংকুর ,
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশ নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর মানুষের মনে স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস থাকলেও বাস্তবতা ছিল জটিল—রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং সামাজিক পুনর্গঠন। সেই সময়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু খবর পরিবেশন করা নয়, সমাজকে বিশ্লেষণ এবং চিন্তা করার সুযোগ দেওয়াও ছিল সাংবাদিকতার দায়িত্ব। ঠিক সেই সময় একজন প্রগতিশীল সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে আবির্ভূত হন মিনার মাহমুদ। তিনি কেবল সংবাদ পরিবেশন করতেন না, বরং সমাজের নানা সমস্যা ও সংস্কৃতির বহুমাত্রিক চিত্র তুলে ধরতেন।
এক চিঠি, এক জীবন
‘‘আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, তোমার মতো মেয়ে হয় না। কিন্তু আমি বাঁচতে পারলাম না…’’—মিনার মাহমুদের শেষ চিঠির এই অংশ হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। এটি কেবল ব্যক্তিগত বেদনার নয়, বরং সেই সমাজের আঘাতের প্রতিফলন, যেখানে সাংবাদিকের জন্য নিরাপদ কাজের সুযোগ সীমিত। ১৮ বছরের দাসত্বের জীবন শেষে নতুন আশা নিয়ে দেশে ফিরে এসে তিনি হতাশ হন। চেষ্টা করেছিলেন নতুন পত্রিকায় যোগ দিতে, কিন্তু কোথাও স্থান পাননি। এই চিঠিতে প্রকাশ পায় তার জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত দম।
সাংবাদিকতার নতুন সূর্যোদয়
১৯৭২ সালের কথা। দেশ তখন নতুন স্বাধীনতার উচ্ছ্বাসে আচ্ছন্ন, কিন্তু বাস্তবতা জটিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক পুনর্গঠন—সব মিলিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সময়। ঠিক সেই সময়ে মিনার মাহমুদ আবির্ভূত হন। তিনি কেবল খবর পরিবেশন করতেন না, সমাজের সমস্যা, সংস্কৃতি ও মানুষের কাহিনী তুলে ধরতেন।
সাপ্তাহিক বিচিত্রার জন্ম
মিনার মাহমুদের হাত ধরে জন্ম নেয় সাপ্তাহিক বিচিত্রা—বাংলাদেশের প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা। এটি কেবল সংবাদপত্র নয়; এটি একটি জীবন্ত মঞ্চ। পাঠক কেবল খবর পড়তেন না, তারা বিষয়গুলো অনুভব করতেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, সাংস্কৃতিক প্রতিবেদন, আন্তর্জাতিক খবর—সবই বিচিত্রার অন্তর্গত।
ছবি, শব্দ, সত্য
ফটোজার্নালিজম তখন খুব প্রচলিত ছিল না। কিন্তু বিচিত্রা ছবিকে সংবাদে প্রাধান্য দিত। গল্প হয়ে উঠত চোখের সামনে। প্রতিটি প্রতিবেদন ছিল বিশ্লেষণধর্মী, সহজ ভাষায় লেখা, কিন্তু গভীর অর্থপূর্ণ। রাজনীতি, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সামাজিক অস্থিরতা—সবই বিচিত্রার পাতায় পাঠকের সামনে আসত জীবন্তভাবে।
সাংস্কৃতিক চেতনাকে জাগানো
মিনার মাহমুদ বিশ্বাস করতেন, একটি সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে তার সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। বিচিত্রার পাতায় নিয়মিত প্রকাশিত সাহিত্য, নাটক, সংগীত ও চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রতিবেদন পাঠককে চিন্তাশীল করে তুলত। অনেক নতুন লেখক ও শিল্পী বিচিত্রার মাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছিলেন।
ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি
মিনার ভাই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে দেখেছিলেন। বিচিত্রা অফিসে প্রথম পরিচয়, তারপর নিয়মিত ফোন ও সাক্ষাৎ। তিনি আমাকে বলতেন—‘‘লিখে যেতে হবে বাংলাদেশের জন্য, মানুষের জন্য।’’ সাংবাদিকতার সততা, মানবিক সহমর্মিতা এবং সত্যনিষ্ঠা—এই তিনটি মান ছিল তার জীবনের মূল নীতি।
জীবনযুদ্ধ ও চরম হতাশা
সর্বশেষ চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন—‘‘আমার কাছে মাত্র ৪ হাজার টাকা আছে, কোন সহায়সম্পত্তি নেই… আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম।’’ এটি কেবল ব্যক্তি নয়, সমাজের প্রতিফলন। তার মৃত্যু আমাদের জন্য এক সতর্কবার্তা—সাহসী, সত্যনিষ্ঠ ও মানবিক সাংবাদিকদের জন্য সমাজ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
স্বাস্থ্য ও প্রবাস জীবন
গত কয়েক বছরে মস্তিষ্কের বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয়, চিকিত্সকের পরামর্শে পূর্ণ বিশ্রামে ছিলেন। আশির দশকে তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে বিবাহ, পরে আমেরিকায় প্রবাসী জীবন, বিয়ের জটিলতা—সব মিলিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন কঠিন ছিল। তবে সাংবাদিকতার নীতি কখনো ক্ষুণ্ণ হয়নি।
সাংবাদিকতা ও প্রজন্মের শিক্ষা
বিচিত্রা তরুণ সাংবাদিকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস ছিল। এখানে কাজ করা সাংবাদিকরা শিখতেন কীভাবে বিশ্লেষণধর্মী লেখা তৈরি করতে হয়, কীভাবে সত্যকে সাহসের সঙ্গে প্রকাশ করতে হয়, এবং সমাজের পক্ষে দাঁড়ানোর মানসিকতা অর্জন করতে হয়। মিনার মাহমুদ তাদের শিক্ষক, মেন্টর ও নির্দেশক ছিলেন।
বিচিত্রার প্রভাব
১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে বিচিত্রা গণমাধ্যমের এক স্তম্ভ। এটি শুধু সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যম নয়, জনমত গঠনেরও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ১৯৯০-এর গণআন্দোলনে বিচিত্রার প্রতিবেদন জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে। সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের দাবি, ছাত্র আন্দোলন—সবই বিচিত্রার পাতায় জীবন্ত।
মৃত্যু ও চিরস্মরণ
২০১২ সালের মার্চ মাসে বিখ্যাত সাংবাদিক মিনার মাহমুদের আত্মহত্যার ঘটনা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। আশির দশকের আলোচিত সাময়িকী ‘বিচিন্তা’র সম্পাদক ছিলেন মিনার মাহমুদ। ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের সপ্তম তলার একটি কক্ষ থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। সে সময় ওই কক্ষে প্রায় ১০০টি ঘুমের বড়ির খোসা পেয়েছিল পুলিশ। হোটেলকক্ষ থেকে মিনার মাহমুদের লাশের সঙ্গে পাঁচ পৃষ্ঠার একটি চিঠিও পাওয়া গিয়েছিল, যা তিনি লিখেছেন স্ত্রী লাজুককে উদ্দেশ করে। লাজুকের সঙ্গে বিয়ের আগে তার দাম্পত্য কাটে নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে। মিনারের চিঠিতে জাগতিক অসফলতা নিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল গভীর এক হতাশা। ‘‘চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মিনার মাহমুদ’’—এই কথাটি শুধু স্মৃতি নয়, দায়িত্বের আহ্বান। সাংবাদিকতার সততা, সাহস এবং মানবিক সহমর্মিতা তাঁর জীবন থেকে শিখতে পারি। আমাদের দায়িত্ব হবে তার স্বপ্ন, নীতি ও সাংবাদিকতার দর্শন জীবিত রাখা। মিনার মাহমুদ ও সাপ্তাহিক বিচিত্রা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয়। সত্যনিষ্ঠ, মানবিক এবং সাহসী সাংবাদিকতার উদাহরণ হয়ে থাকবেন তিনি। তাদের জীবন ও কাজ আজকের এবং আগামী প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্য এক অনন্ত অনুপ্রেরণা।