আপনার সঙ্গে একটা মাত্র ছবি ছিল আরিফ ভাই। আমাদের মিছিলের। ছাত্র আন্দোলন করা জীবনের। জাতীয় কমিটির ২০১১ সালের ৩ জুলাইয়ের হরতালের। আমরা হাতে হাত ধরে সামনের কাতারে হাঁটছিলাম। পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চক্কর দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম শাহবাগ অভিমুখে। তারপরই পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দিল। গ্রেফতার করল ফায়েজ ভাই, জিন্নাহসহ আরও কয়েকজনকে। শাহবাগ থানার সামনের সড়কদ্বীপে দাঁড়িয়ে আপনি বিপুল বিক্রমে জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুরু করলেন। আমরা লড়াইয়ের আরও বারুদ পেলাম।
আপনি ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে কতটা সুনাম কুড়িয়েছেন তা আমরা যারা প্রত্যক্ষদর্শী, তারা কেউই ভুলব না। আপনি প্রগতিশীল ছাত্র জোটের জনপ্রিয় নেতাদের একজন ছিলেন। আমরা একই ছাত্র সংগঠন করিনি, ঠিক। ছাত্র ইউনিয়ন করেছি বলে, আমাদের মতাদর্শিক পার্থক্য আজও আছে। কিন্তু আপনাকে আমি দল-মতের উর্ধ্বে আমার নেতা জ্ঞান করতাম। আপনার কাতারে দাঁড়িয়ে মিছিল করতে পেরেছি, এই বোধটি আমাকে অনুপ্রাণিত করত। আর আজ থেকে তো খুঁজে না পাওয়া সেই হরতালের ছবিটা চিরজীবন স্মৃতি হিসেবে মনের কোঠায় আগলে রাখব।
মনে পড়ে, ঢাবি কি জাবি কি পঞ্চগড় -- যেখানেই আমাদের মোলাকাত হয়েছে, আপনার সঙ্গে গল্পের ঝাঁপি নিয়ে বসতে কোন ইস্যুর দরকার ছিল না। আপনার চরিত্রের মধ্যেই আড্ডাকে প্রাণবন্ত করার রসদ ছিল সদাসর্বদা।
আপনার আটোয়ারীর বাড়িতে সর্বশেষ যেদিন রাতের খাবার খেলাম, তখন কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছি যে আর দেখা হবে না! আপনার সঙ্গে কিছুদিন আগেই কথা হলো ইউপিএলে বই প্রকাশের ব্যাপারে। আমার বই প্রকাশের ব্যাপারে আপনার সে কি আগ্রহ! সময়ের অভাবে আজও যাওয়া হলো না ইউপিএল অফিসে বলে আপনার সঙ্গে দেখাটাও হলো না! আর তো দেখা হবে না আরিফ ভাই!
মাত্র চল্লিশে এ কেমন চলে যাওয়া!
ঘাতক ট্র্যাক কি জানল, এদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও স্বপ্নবাজ তরুণদের একজনকে মোটরসাইকেল চালানো অবস্থায় চাপা দিয়ে মেরে ফেলে রেখে গেল সে রাজধানীর বুকে! একে সড়ক দুর্ঘটনা কী করে বলি? এটা তো পরিষ্কার কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড! যখন ট্র্যাক আপনাদের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়, তখনও থামিয়ে দিলে হয়তো বেঁচে যেতেন। কিন্তু, ট্র্যাক ড্রাইভারকে দ্রুত পালাতে হবে, তাই আপনাদের দুই বন্ধুর (আরিফুল ইসলাম ও সৌভিক করিম) উপর দিয়ে চাকা উঠিয়ে দিল। একে হত্যাকাণ্ড বলা যাবে না? আমরা সন্দেহ করতে পারব না, কেন এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নয়?
মনে আছে, পঞ্চগড়ে এক শীতের রাতে আমরা ভ্যানে তিতোপাড়া যাচ্ছিলাম বেশ কয়েকজন। আমি দেশে ফেরায়, বহুদিন পর আমাদের দেখা ও কথা। সেদিন আমাদের লম্বা রাজনৈতিক-একাডেমিক-পারিবারিক আলাপের অনেক বিষয়ের একটি ছিল কিশোর দা। ফয়সাল রহমান কিশোর, আমাদের জাহাঙ্গীরনগরের নেতা ছিলেন। কিশোর দা'র অকালে চলে যাওয়ার বেদনা ও আফসোস আপনার ভেতর থেকে কেমন অজান্তেই যেন জানান দিচ্ছিল। বন্ধুর বিয়োগে বিয়োগান্ত মন!
আপনিও তো অকালেই চলে গেলেন, আরিফ ভাই!
এ কেমন অবিশ্বাস্য চলে যাওয়া!
নীলা আপা ও আপনার একমাত্র সন্তান নক্ষত্রের জন্য কোনো সমবেদনা জানানোর ভাষা নেই। নক্ষত্র হয়তো এখন বুঝবে না পিতৃশোক কী, পিতা হারানোর বেদনা কী! একদিন ও বড় হবে, নীলা আপাকেও শোক কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে আসতে হবে। নক্ষত্র বহু বছর পরে নিশ্চয়ই একদিন জানবে, 'আমার বাবা তার সময়ের নায়কদের একজন ছিল।'
আপনি সমাজ বদল করতে চাওয়া তরুণদের একজন নেতা ছিলেন। বেঁচে থাকার আগ পর্যন্ত আপনি নিশ্চয়ই মাথায় রেখেছিলেন, ৭ নভেম্বর মহান রুশ বিপ্লব বার্ষিকীর কথা। আমাদের স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা কি এমন দিনই বেছে নেয় তাদের মনে রাখানোর জন্য!
রেস্ট ইন পিস, আরিফ ভাই, আওয়ার ভিশনারি লিডার!
লেখক: সৌমিত জয়দ্বীপ
এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, স্কুল অফ জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি