'উপস্থিত স্যার' বলা যেত না। বলতে হতো 'উপস্থিত জনাব'৷ শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে হতো 'সংযোগ-ঘণ্টা'য়, মানে ক্লাসে।
শৃঙ্খলানিষ্ঠ একটি হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব নিয়ে তিনি চলতেন এবং বোধকরি এ ব্যক্তিত্বের গাম্ভীর্য বিষয়ক নানা গল্প ক্যাম্পাসের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে আছে আজও।
কড়া ছিলেন। ছিলেন স্থিতিস্থাপক। পরিপাটি, অন্তর্মুখী, আত্মমগ্ন ধ্রুপদী যুগের শিক্ষকদের অনুরূপ ছিলেন তিনি। ছিলেন মৃদুস্বরের মিতভাষী ব্যক্তি। হাসি ছিল বিরলতম স্মিত, দাঁত তো প্রায় বের হতোই না বলা যায়!
ফলত, ছিলেন দূরতম তারা। ছিলেন শিক্ষকদেরও শিক্ষক। আমাদের সেই শিক্ষকবৃন্দও তাঁকে সমীহ করে চলতেন। দূরত্ব হয়তো সে কারণেও ছিল। তাঁর সামনে নিজেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মনে হতো৷ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী তিনি আমাদের মনে করতেন কি না, সে নিয়েও সংশয় ছিল আমার।
সংযোগ-ঘণ্টায় আলাপ তুলতেন, 'আমার বন্ধু হুমায়ুন আজাদ বলতেন "তর্কে মিলায় বস্তু, বিশ্বাসে বহুদূর", আমি অবশ্য বরাবরই "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর" ঘরানারই লোক।' প্রথাগত থাকাকেই তিনি জীবনাদর্শ মনে করতেন।
পড়াতেন ভাষাবিজ্ঞান। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কাজ ও গবেষণার জায়গা। সে প্রসঙ্গেই অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের নাম নিতেন। শ্রেণিকক্ষে তাঁর আত্মনিবেদন নিয়ে কেউ কোনদিনও প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। পরিস্থিতি যাই হোক, এমনকি হরতাল হলেও, তিনি শ্রেণিকক্ষে আসবেনই, এ নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় ছিল না। ভাষাবিজ্ঞান যেহেতু খটমট বিষয়, ফলে, সংযোগ-ঘণ্টা খুব যে আনন্দময় ও উপভোগ্য হতো, তা নয়। খোদ বিষয়টাই এমন যে, কাঠিন্যই তার ধর্ম! পড়াতেনও একজন কঠিন মানবহৃদয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী শিক্ষক। ফলে, আত্মনিবেদিত শিক্ষক পেয়েও ভাষাবিজ্ঞানে ঠিকঠাক 'সদ্গতি' ঘটেনি! কখনও কখনও অবশ্য এমনও মনে হতো, তাঁর জ্ঞানের উচ্চতার কারণেই ভাষাবিজ্ঞান আমাদের কাছে এতো কঠিন লাগছে!
একদিন তাঁর শ্রেণিকক্ষে তিরস্কৃত হওয়ারও অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কোনো কারণে নিয়মিত লেখার যে বড় হলুদ মলাটের ডায়েরি (পাঁচ বছরে ওই একটা ডায়েরি ব্যবহার করায় বন্ধুবান্ধবদের গল্পের খোরাক হয়ে উঠেছিল এই বস্তুটি!), সেটা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। বদলে প্রতিনিয়ত সঙ্গে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পকেট ডায়েরিতে তাঁর বক্তব্য তুলতে গিয়ে তিনি সেটা দেখে ফেলেন এবং নিজের কাছে রেখে দিলেন। শ্রেণি-সংযোগ শেষে দেখা করতে বললেন। ডায়েরিতে সমস্ত রাজনৈতিক কথাবার্তা লেখা। তিনি এসব দেখে কিছু বলেননি আর। শুধু গুরুগম্ভীর স্বরে বলেছিলেন, 'এমনটা যেন আর কখনো না হয়।'
নানা কারণেই তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। তাঁর থেকে দূরে থাকাকেই হয়তো শ্রেয়তর মনে হয়েছে অনেকেরই, আমারও। কিন্তু, শিক্ষক হিসেবে তিনি নির্মল, সুকুমার ও সর্বশ্রদ্ধেয় ছিলেন। প্রথাবিরোধী তিনি ছিলেন না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কদর্য শিক্ষক রাজনীতিতেও আমরা অন্তত তাঁকে জড়াতে দেখিনি। আবার, বিভাগ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের ক্রান্তিলগ্নে তাঁর অবস্থান কী, সেটাও জানার উপায় ছিল না। তবে, তথাকথিত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিদ্যায়তনিক হিসাব-নিকাশ তাঁর ছিল না বলেই হয়তো তিনি তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা ধরে রেখেই মহীরুহ শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেছেন।
আজ তিনি চিরঅবসরে গেলেন। দেহাবসান হলো তাঁর। জাবির বাংলা বিভাগের এ বছরের সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে তিনি মধ্যমণি ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গোড়াপত্তন যাঁদের হাতে, তিনি তাঁদেরই একজন। যোগদানের হিসাবে বিভাগের প্রথম শিক্ষক। আর ছিলেন আমাদের কালে বিভাগের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজ্যেষ্ঠ অধ্যাপক।
ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হক, শিক্ষকদের শিক্ষক, আপনার অনন্ত যাত্রা শুভ হোক! বিনম্র শ্রদ্ধায় ও কৃতজ্ঞতায় আপনার স্মৃতি ও কৃতির প্রতি কুর্নিশ জানাই, স্যার! না, দুঃখিত, জনাব!
লেখক: সৌমিত জয়দ্বীপ
এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, স্কুল অফ জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি