শিতাংশু ভৌমিক অংকুর,
বহু সময় ধরে মানুষ ধরে নিয়েছে সত্য স্থির, চিরন্তন এবং সর্বজনীন। কিন্তু বাস্তবতা দেখিয়েছে, সময়, জ্ঞান, সামাজিক প্রেক্ষাপট ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সত্যের রূপ পরিবর্তিত হয়। আমরা যে বিষয়গুলোকে নিঃসন্দেহে সত্য মনে করি, তা অনেক সময় ইতিহাস, বিজ্ঞান, সামাজিক পরিবর্তন এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে বদলে যায়।
মিশেল ফুকো এখানে বলেছেন, “যে ক্ষমতা ধারণ করে, সে তার সত্যই প্রতিষ্ঠিত করে; কিন্তু মানবিক সত্য সর্বদা স্বাধীন।” [Discipline and Punish: The Birth of the Prison, 1975] এই কথাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যকে প্রমাণ বা অভিজ্ঞতার আলোকে যাচাই করতে হবে। তাই বলা যায়—‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’। তবে এর মানে সত্যের অনুসন্ধান থামানো নয়; বরং আরও সতর্ক, যুক্তিবাদী এবং সচেতনভাবে সত্যকে বোঝার প্রয়োজন।বিজ্ঞানের ইতিহাসই সত্যরূপান্তরের এক জোরালো প্রমাণ। প্রাচীন মানুষ বিশ্বাস করত পৃথিবী সমতল; কপারনিকাস, গ্যালিলিও ও কেপলারের গবেষণার পর বোঝা গেল পৃথিবী গোলাকার এবং সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের কোষ্ঠকাঠিন্য, যেমন আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব, দেখিয়েছে নিত্যসত্যও পরীক্ষার ওপর নির্ভরশীল।
হেনরি ডেভিড থোরো এখানে লিখেছেন, “মানবতার ইতিহাসে সত্যের সন্ধান কখনো স্থির নয়, তবে অনুসন্ধানই অমর।” [Walden, 1854] এটি প্রমাণ করে, বিজ্ঞান নিজেই স্বীকার করে যে সত্য কখনো চিরন্তন নয়; এটি প্রমাণ, অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন তত্ত্ব বলে গ্যালাক্সি স্থির; কিন্তু আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল এবং গ্যালাক্সি অবিরাম আন্দোলনশীল।বিজ্ঞানের এই পরিবর্তনশীল সত্য আমাদের শেখায়, নতুন তথ্য ও প্রমাণ গ্রহণ না করলে অগ্রগতি সম্ভব নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বহু প্রথাগত পদ্ধতি আজকাল পরিবর্তিত হয়েছে কারণ নতুন গবেষণা ও পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই পরিবর্তন দেখায় সত্য কখনো চিরন্তন নয়; বরং এটি মানুষের অনুসন্ধান এবং উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে মানুষের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তিত হয়।সমাজ ও নৈতিকতাও সময়ের সঙ্গে বদলায়। এক সময়ে দাসপ্রথা বৈধ এবং নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মনে হতো। নারীদের শিক্ষা সীমিত ছিল, বিধবা বিবাহ অগ্রহণযোগ্য। সময়ের সঙ্গে মানবতার উন্নতি, ন্যায়বোধ ও সংগ্রামের মাধ্যমে এসব ‘সত্য’ পাল্টে গেছে। মানবাধিকার আন্দোলন, শিক্ষার প্রসার এবং সমতার দাবি সমাজে একটি নতুন নৈতিক মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছে। ফ্রান্সের দার্শনিক ব্লেইজ পাস্কাল এখানে লিখেছেন, “সত্য কখনো এক নয়; এটি সময়, অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বদলায়।” [Pensées (Thoughts)-1670] বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিধবা বিবাহকে অশুভ বলা হতো; কিন্তু আজ তা সামাজিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নিয়েও যুগে যুগে ধারণা বদলেছে। আগে নারীকে প্রধানত গৃহকর্মের সঙ্গে সীমাবদ্ধ করা হতো, কিন্তু এখন নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অধিকারের প্রশ্নে সমাজ সমানাধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। রাজনীতি প্রায়ই সত্যকে ক্ষমতার হাতের খেলার মতো তৈরি করে। ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী বা শাসকের বক্তব্য কখনো সমাজের স্বীকৃত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঔপনিবেশিক শাসকদের “সভ্যতার আলো” ছড়ানোর দাবি ছিল তাদের সত্য; কিন্তু স্বাধীনতা ও আন্দোলনের পর প্রকৃত বাস্তবতা—শোষণ—উন্মোচিত হয়।আলবার্ট আইনস্টাইন এখানে বলেছেন, “যা এক যুগে সত্য, পরবর্তী যুগে তা মিথ্যা হতে পারে।” [Ideas and Opinions, 1954] ঠান্ডা যুদ্ধের সময় বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, এবং উভয়ই নিজেদের সত্যকে সর্বজনীন বলে প্রচার করত। ইতিহাস দেখিয়েছে, উভয় দিকের সত্যই প্রায়শই রাজনৈতিক স্বার্থের দ্বারা নির্ধারিত। এই বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় সত্য কখনো সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নয়; ক্ষমতা ও স্বার্থ প্রায়ই সত্যকে প্রভাবিত করে।
স্থানীয় রাজনীতিতেও প্রচলিত সত্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ক্ষমতার ছায়ায় পরিবর্তিত হয়। এক সময় কিছু অঞ্চলে সাধারণ জনগণের অধিকার সীমিত করা হতো, কিন্তু সামাজিক আন্দোলন ও আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সেই ‘সত্য’ পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তন দেখায়, সত্য শুধু দৃষ্টিভঙ্গি বা অভিজ্ঞতার উপরই নির্ভর করে না; এটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সাথেও জড়িত।ব্যক্তিগত জীবনে সত্য আরও নরম এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিবর্তিত। শিশুর চোখে যা সত্য, প্রাপ্তবয়স্কের চোখে তা ভিন্ন হতে পারে। ভালোবাসা, দায়িত্ব, সম্পর্ক এবং অর্থ—এসব ধারণা জীবনের পর্যায় পরিবর্তনের সঙ্গে ভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়। জীবনের ব্যর্থতা বা সাফল্য মানুষের সত্যের ধারণাকে পুনঃনির্মাণ করে।ফ্রান্সের দার্শনিক ব্লেইজ পাস্কাল এখানে লিখেছেন, “সত্য কখনো এক নয়; এটি সময়, অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বদলায়।” [Pensées (Thoughts)1670] এটি দেখায় ব্যক্তিগত জীবনে সত্যও পরিবর্তনশীল এবং অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল। মানুষের মূল্যবোধ, আশা ও প্রত্যাশার সঙ্গে সত্যের রূপও পরিবর্তিত হয়। এই প্রক্রিয়াটি শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনকেও প্রভাবিত করে।
ডিজিটাল যুগে তথ্যপ্রবাহ ও সামাজিক মিডিয়ার প্রভাব সত্যকে বিভ্রান্ত করছে। ফেক খবর, প্রোপাগান্ডা এবং সামাজিক মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ—এসব মিলেই তৈরি করেছে পোস্ট-সত্য পরিবেশ। অনুভূতি প্রায়ই প্রমাণের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী। ব্যক্তিগত ইকো-চেম্বার এবং পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়ার কারণে সমাজে একাধিক ‘সত্য’ তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সমালোচনামূলক চিন্তা, গণমাধ্যম সাক্ষরতা এবং তথ্য যাচাইয়ের সংস্কৃতি অপরিহার্য।
একজন সচেতন মানুষকে উৎস, প্রেক্ষাপট ও স্বার্থ বিশ্লেষণ করে তথ্য গ্রহণ করতে হবে। সামাজিক মিডিয়ার গোষ্ঠীভিত্তিক প্রভাব, রাজনৈতিক প্রচারণা এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সত্য বিকৃত হতে পারে। তাই ব্যক্তি ও সমাজকে একত্রিত হয়ে সমালোচনামূলকভাবে তথ্য যাচাই করতে হবে।
‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’—এই কথাটি প্ররোচিত করে আমাদের চিন্তা, তবে এটি মানে অনুসন্ধান থামানো নয়। সত্য যদি পরিবর্তনশীল হয়, তা মানে আমরা আরও সতর্ক, যুক্তিবাদী ও ন্যায্য উপায়ে সত্যের সন্ধান চালাব।
মিশেল ফুকো এখানে বলেছেন, “পুরানো সত্য ভেঙে নতুন সত্যকে গ্রহণ করাই সভ্যতার চিরন্তন নিয়ম।” [The Archaeology of Knowledge, 1969] সত্যের এই আপেক্ষিকতা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে। পুরানো সত্য ভেঙে নতুন সত্যকে গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ বিজ্ঞানে, সমাজে, রাজনীতিতে এবং ব্যক্তিজীবনে উন্নতি করেছে। তাই সত্যের পরিবর্তনকে ভয় নয়, বরং বোঝা ও গ্রহণ করাই আমাদের পরিণত দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ।
এই পরিবর্তনশীল প্রকৃতির সত্য আমাদের শেখায়, জ্ঞান কখনো সম্পূর্ণ চিরন্তন নয়। প্রতিটি যুগ, প্রতিটি অভিজ্ঞতা এবং প্রতিটি প্রেক্ষাপট আমাদের নতুন সত্যের দিকে পরিচালিত করে।
লেখক: সাংবাদিক



