বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর উদ্যোগে আজ ১৯ আগস্ট ২০২২ সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আন্দোলনরত চা শ্রমিকদের সংহতি জানিয়ে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বাসদ এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ এর সভাপতিত্বে এই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় নেতা ডাঃ হারুণ অর রশীদ, ৯ বাম সংগঠনের সমন্বয়ক ও নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চার সভাপতি জাফর হোসেন, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, বাসদ ঢাকা মহানগরের নেতা আহসান হাবিব বুলবুল ও খালেকুজ্জামান লিপন। সভা পরিচালনা করেন বাসদ ঢাকা মহানগরের সদস্য সচিব কমরেড জুলফিকার আলী। সভায় নেতৃবৃন্দ সারা দেশের ২৪১টি চা-বাগানের শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে অবিলম্বে মজুরি বৃদ্ধিসহ ন্যায়সংগত দাবি মেনে নেয়ার জন্য মালিক-সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
নেতৃবৃন্দ বলেন, দেশের সব থেকে অবহেলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠি হলো চা-শ্রমিকেরা। দেশের অন্য যেকোন খাতের তুলনায় চা-শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। দিনে ২৩/২৪ কেজি চা-পাতা (নিরিখ) তুলতে পারলেই তাদের মজুরি মাত্র ১২০ টাকা পায়। এতো কম মজুরি দেশের আর কোন শ্রমিকের নাই। তাদের না আছে কোন ভালো থাকার জায়গা, সুপেয় পানি, চিকিৎসা ও সন্তানের লেখাপড়ার ব্যবস্থা। নিয়ম অনুযায়ী ২ বছর পর পর মজুরি পুননির্ধারণ হওয়ার কথা। কিন্তু দালাল শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিকদের যোগসাজসে প্রতিবারেই দেড়/ দুই বছর মজুরি নির্ধারণ প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখে শ্রমিকদের ঠকানো হয়। এবারেও মজুরি নির্ধারণের সময় প্রায় ২০ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও মজুরি বোর্ড এর কোন তৎপরতা না থাকায় শ্রমিকেরা ৯ আগস্ট থেকে প্রথমে দিনে ২ ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করে। এতেও মালিক-সরকারের টনক না নড়ায় গত ১৩ আগস্ট থেকে দেশের ২৪১টি বাগানে পূর্ণ কর্ম বিরতি পালন করছে চা-শ্রমিকেরা। ইতিমধ্যেই চা-শ্রমিকদের আন্দোলন পুলিশ দিয়ে দমনেরও চেষ্টা করা হয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে কমরেড ফিরোজ বলেন, চা বাগানের শ্রমিকেরা শ্রীমঙ্গল ও ঢাকায় তিনদফা সরকার ও মালিক পক্ষের সাথে বৈঠক করেছে। কিন্তু মালিক পক্ষ ও সরকার নানা তালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করছে। শ্রমিকরা দাবি করেছে মজুরি ৩০০ টাকা করতে হবে। বাগানের শ্রমিকদের ছুটি বৈষম্য দূর করতে হবে। রেশনের মান ও পরিমাণ বাড়াতে হবে। সন্তানদের জন্য প্রত্যেক বাগানে প্রাথমিক স্কুল ও প্রত্যেক ভ্যালিতে উচ্চ বিদ্যালয় করতে হবে। প্রতিটি বাগানে মানসম্মত চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সরকারের পক্ষ থেকে দিন মজুরদের মজুরি দৈনিক ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানের বাজার দর অনুযায়ী চা-শ্রমিকের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি কমপক্ষে ৫০০ টাকা হওয়ার কথা। অথচ চা-শ্রমিকেরা মাত্র ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করার পরও তা মানছে না মালিকেরা। তিনি বলেন, ভারতে যেখানে চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩২ রুপি বা ৪২০ টাকা। আবার ভারতে যেখানে ১৬ কেজিতে নিরিখ আর বাংলাদেশে নিরিখ ২৩/২৪ কেজি। পুরা নিরিখ তুলতে না পারলে মজুরি কমে যায় প্রতি কেজিতে ৬ টাকা। অথচ অতিরিক্ত তুললে পায় প্রতি কেজিতে ২ টাকা। বাগানগুলোতে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির কোন তোয়াক্কা করা হয় না। শিক্ষা-চিকিৎসাসহ নানা ধরণের সুবিধার অপ্রতুলতার দরুণ শত শত বছর ধরে এই শ্রমিকেরা তাদের পরিবার নিয়ে অমানবিক জীবন যাপন করছে। তার থেকে মুক্তির লক্ষ্যেই এই আন্দোলন।
কমরেড ফিরোজ বলেন, আন্দোলন চলাকালীন সময়ে শ্রমিকদের জন্য রেশন বন্ধ করা যাবে না। অন্যথায় অন্যান্য বাম প্রগতিশীল শক্তিকে সাথে নিয়ে বাসদ এর পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী চা শ্রমিকদের জন্য লোঙ্গরখানা খুলে খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। এরই মধ্যে খবর এসেছে ফিনলে চা বাগানে শ্রমিকদের নামে ৪টি মামলা করা হয়েছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, রেশন বন্ধ করে, মামলা দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। অবিলম্বে এসকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করার দাবি করেন তিনি।
কমরেড ফিরোজ দাবি করেন, চা বাগানগুলো একর প্রতি নামমাত্র মূল্যে মাত্র ৫ টাকায় লীজ নেয়া হয়। তারপরেও নাকি মালিকের মুনাফা হয় না? তিনি সরকারের নিকট দাবি জানান মালিকেরা শ্রমিকদের দাবি না মানলে সরকার বিনা ক্ষতিপূরণে বাগানগুলো রাস্ট্রায়ত্ত্ব করে নিক এবং সরকারিভাবে সেগুলা পরিচালনা করা হোক।
কমরেড ফিরোজ আরও বলেন, এই সরকার জনগণের ভোটে আসে নাই। মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করে আসছে সরকার। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। জ্বালানিমন্ত্রী আবারো বলছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে। ৫৩ শতাংশ মানুষ তাদের খাদ্যগ্রহণ কমিয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ২৫ আগস্ট সারা দেশে বামপন্থিদের পক্ষ থেকে আধাবেলা হরতাল আহ্বান করা হয়েছে।
তিনি অবিলম্বে চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিসহ ন্যায়সংগত সকল দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। একই সাথে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য চা শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানান এবং সকল বাম-প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক জনগণকে চা-শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।