ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের উপর ছাত্রলীগের হামলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের উপর ছাত্রলীগের হামলা

বিরোধী দলের মিছিল–সমাবেশে বাধা দেওয়া হবে না—ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন আশ্বাস দেওয়ার তিন সপ্তাহ না পেরোতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হামলা ও মারধরের শিকার হয়েছে ছাত্রদল। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতা–কর্মীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় চালানো এ হামলায় ছাত্রদলের অন্তত ৩০ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় সংবাদ সম্মেলনের কর্মসূচি ছিল ছাত্রদলের। এ সংবাদ সম্মেলন করার আগে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সংগঠনের নেতা–কর্মীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে জড়ো হতে থাকেন। এরপর সেখান থেকে মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) দ্বিতীয় তলায় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে যাওয়ার পথে শহীদ মিনারের কাছে হামলার শিকার হন ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা।

এর আগে গত সোমবার বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা। সেদিন সিলেট শহরের আলিয়া মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রদলের নেতা–কর্মীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। আর বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল।

গতকাল সকালে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের ওপর হামলাকে ‘প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ’ বলে দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘ছাত্রদল তাদের সহিংস সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ বিঘ্নিত করছে। এর ধারাবাহিকতায় তারা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছে। শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখা ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপদ শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করার স্বার্থে সব মতের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছাত্রদলের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।’

তবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ১২ জন শিক্ষার্থী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সাদ্দামের বক্তব্যের বিপরীত। তাঁরা বলছেন, গতকাল সকাল থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান করছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তাঁরা মহড়া দিচ্ছিলেন। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের গেটের কাছ থেকে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে টিএসসির দিকে এগোতে থাকলে প্রথমে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে হামলার শিকার হন। ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা হকিস্টিক, পাইপ ও লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালান। কারও কারও হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র বলছে, হামলায় আহত নেতা-কর্মীদের প্রাথমিক চিকিৎসা চলার মধ্যেই বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন ছাত্রদলের দুই শতাধিক নেতা–কর্মী। মিছিলটি কিছু দূর এগোনোর পর আশপাশ থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তখন ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারা সেখানে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ হলের সামনে) উপস্থিত হন। এরপর ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা আবার সংগঠিত হন। অবশ্য তখন তাঁদের অনেকের হাতে কাঠ, লাঠি ও বাঁশের টুকরা ছিল। রাস্তা ও আশপাশের দোকান ও ফুটপাত থেকে এসব সংগ্রহ করেন তাঁরা। একপর্যায়ে তাঁরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ধাওয়া দেন। ধাওয়ায় প্রথমে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পিছু হটেন। এরপর ছাত্রদল মিছিল নিয়ে দোয়েল চত্বরের সামনে অবস্থান নেয়। আর ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা দোয়েল চত্বরের পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের সামনের রাস্তায় অবস্থান নেন। এ পর্যায়ে দুই পক্ষে মুহুর্মুহু ঢিল ছুড়তে থাকে। এর মধ্যেই ছাত্রলীগের আরও নেতা-কর্মী সেখানে জড়ো হতে থাকেন। পরে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা ছাত্রদলকে পাল্টা ধাওয়া দেন। তখন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা চানখাঁরপুল হয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র বলছে, সবাই ক্যাম্পাস ছেড়ে গেলেও ছাত্রদলের দুজন ক্যাম্পাসে আটকা পড়েন। তাঁদের শহীদুল্লাহ্ হলের নর্দমায় ফেলে পেটান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ওই দুজন ঢাকা মহানগর পূর্ব শাখা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি মিনহাজুল আবেদীন ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কর্মী আল আমিন। মারধর করার পর তাঁদের রিকশায় তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান ছাত্রলীগেরই কয়েকজন কর্মী। যদিও পথে মিনহাজুলকে রিকশা থেকে লাথি দিয়ে আবার ফেলে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য আরেকটি রিকশায় করে মিনহাজুলকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। এ সময় সেখানে এক পুলিশ সদস্য উপস্থিত থাকলেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নিবৃত্ত করতে তাঁর কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। এ ছাড়া দুপুরে টিএসসি এলাকায় ‘প্রজন্ম নিউজ’ নামের একটি সংবাদমাধ্যমের কর্মী পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তিকে মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

 

এদিকে ছাত্রদলের নেতা–কর্মীদের ওপর হামলা ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার সময় ক্যাম্পাসজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কার্জন হল, মোকাররম ভবন ও কাজী মোতাহার হোসেন ভবনে যেসব বিভাগের শ্রেণিকক্ষ রয়েছে, সেসব বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনেকে ভয়ে ক্লাসে যেতে পারেননি। আবার ক্লাস শেষ হওয়ার পরও দুপুর পর্যন্ত ভয়ে অনেকে ভবন থেকে বের হননি। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন ছিল। উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে শিক্ষকদেরও অনেকে দীর্ঘক্ষণ ভোট দিতে যেতে পারেননি।

গতকাল সকালের ওই হামলায় অন্তত ৩০ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ছাত্রদল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে দুপুরে তাঁদের ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে সরিয়ে নেওয়া হয়।

এদিকে ছাত্রদলের দুজন কর্মীসহ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে শাহবাগ থানা–পুলিশ। কোনা পক্ষই থানায় কোনো অভিযোগ না করায় পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করার বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।