বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতার আধিপত্য, ছাত্র রাজনীতির অপমান

সুমাইয়া সেতু


বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতার আধিপত্য, ছাত্র রাজনীতির অপমান

গত কয়েকদিন থেকে ফেসবুকের টাইমলাইনে যে ছবিটি সব চেয়ে বেশি বার দেখেছি সেটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মারামারির ছবি আর নিচে কোলাজ করে সিলেটে বাঁনভাসী মানুষের জন্যে ছাত্র ইউনিয়নের গঁণতহবিল সংগ্রহের ছবি। যদিও ছাত্র ইউনিয়নের এই কাজটিকে আলাদা করে মহান বলার কিছুই নেই কারণ এটি প্রকৃত অর্থে যে কোন সংগঠনের কাজ তবুও আমাদের চারপাশের পরিবেশকে বিবেচনা করে এই ছবি দিয়ে মানুষকে বোঝাতে হচ্ছে প্রকৃত অর্থে কোনটা একটা ছাত্র সংগঠনের কাজ হতে পারে। আর কোনটা হতে পারেনা। সমাজে ছাত্র রাজনীতি বলতে আজকাল মানুষ ছাত্রলীগ আর ছাত্রদল যেটি করছে সেটিকেই বোঝে। অথচ যেটি সত্যিকারের ছাত্র রাজনীতি সেটি কে উপেক্ষা করতে চায় এদেশের জনগণ এবং ছাত্র সমাজ। যদি সাধারণ ছাত্ররা এই দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে চাইতো, সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সন্ত্রাসকে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিতে চাইতো, সেটি নিঃসন্দেহে সম্ভব ছিলো। কিন্তু এখনো সেই সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাই নি। এই দেখতে না পাওয়ার আর একটা কারণ হতে পারে যে ছাত্ররা জানেই না তারা কতোটা শক্তিশালী। আমাদের সংগঠনের শক্তির চেয়ে সাধারণ ছাত্রদের শক্তি অনেক বেশি কারণ তারা সংখ্যায় অনেক বেশি। কিন্তু যেই আদর্শিক শক্তি নিয়ে আমরা লড়াই করি সেটি অনেক অনেক সংখ্যার চেয়ে আমাদেরই বেশি। তাই যখন যেকোন পরিস্থিতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে আমরা ভয় পাই না। যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে তখন ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে আধিপত্য চালায় আবার যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসে তখন ছাত্রদল আধিপত্য চালায়, আর অপর দলকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন লড়াই করে সব সময় সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আজকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই রকমভাবে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে তখন বার বার মঈন হোসেন রাজুর কথা মনে পড়ে। ঠিক এই রকমই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মিছিল করতে গিয়ে রাজু হারিয়ে যায় সবার মাঝ থেকে। রাজুর গায়ে যে বুলেট বিদ্ধ হয় সেটি ছুড়েছিলো ছাত্র দলের নেতারা। আজকে সেই ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হাতে মার খাচ্ছে। যদিও এইভাবে কারো উপর হামলে পড়া আমরা সমর্থন করি না তবুও এই দায় আসলে উভয় দলকেই নিতে হবে। এই যাবতকালে যেই দল ক্ষমতায় এসেছে সেই দলেরই পালিত ছাত্র সংগঠনই সেই সময়ে চালিয়েছে একক আধিপত্য। ক্ষমতার দম্ভে তারা অন্ধ হয়ে যায়, বিরোধী দলের প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ তাদের থাকে না। আমরা যারা এখন ছাত্র তারা আসলে পুরো শিক্ষাজীবনই ছাত্রলীগের আধিপত্য দেখলাম। আমরা দেখলাম বিশ্বজিৎ, আবরার সহ আরো অসংখ্য হত্যাকান্ড, আমরা সিলেটে এমসি কলেজের ধর্ষণের ঘটনা জানলাম, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, গুম, খুন সব কিছুর সাথে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর জড়িত থাকার খবর আমরা দেখলাম। আর এই সব কিছুই প্রতিমুহূর্তে ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করছে চোখের সামনে৷ আবরারের হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিও উঠতে দেখেছি আমরা। আবার একটু পেছনে ফিরলে বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ঠিক একই সব ঘটনার দায়ে ছাত্রদলের নেতারা জড়িত ছিলো। আমরা শুনেছি এই রকম সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্যে জাতীয় ছাত্র সমাজ কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদ এবং ছাত্ররা। ছাত্র শিবিরের রগ কাটা রাজনীতির কথা নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যায় নি। এরা প্রত্যেকেই একে অপরের পরিপূরক। যখন যার ক্ষমতা সেই জোর দেখায় প্রতিপক্ষের উপর, আর অপর দল সহ্য করে। কিন্তু অপর দল যে খুব ভালো কিছু করছে তেমনটিও না কিন্তু। তারাও সুযোগের অভাবে সৎ হয়ে থাকে।

ছাত্র সংগঠন গুলোর এই অবস্থার জন্যে মুলত তাদের ফাদার সংগঠন বা মূল রাজনৈতিক দলগুলো প্রধানত দায়ী। কারণ অতীতের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস অনেক বেশি গৌরবোজ্জ্বল। এমনকি স্বাধীনতার পরেও ছাত্র সংগঠন গুলো দেশের জন্যে, ছাত্র সমাজের জন্যে অনেক ইতিবাচক কাজ করে গেছে। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে হঠাতেও ছাত্র সংগঠন গুলো প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্রদের যে কোন ন্যায়সংগত দাবিতে তারা ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বর্তমানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে মূল দল গুলো ছাত্র সংগঠনের নিজস্বতা ক্রমাগত নষ্ট করেছে। শিক্ষার্থী বান্ধব কাজ না করে তাদের লেজুড়বৃত্তি করার জন্যে ছাত্রনেতাদের হাতে তুলে দিয়েছে ক্ষমতা। তাদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্যে ছাত্র সংগঠন গুলোকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছে, কারণ তারা নিজেরাই হয়তো ভয় পাচ্ছিলো যে তাদের ক্ষমতায় থাকার অন্যায় লড়াইয়ে যদি ছাত্র সংগঠন গুলোকে পাশে না পায়। পাওয়ার ও কথা ছিলো না, যে সংগঠন সত্যিকার অর্থে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবে সে নিজের দলের অন্যায়ের বিরুদ্ধেও সমানভাবেই লড়াই করবে। আর মূল দল গুলোর যেকোন ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে ছাত্র সংগঠনের দরকার ছিলো, যাদেরকে তারা লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে, যাদের দ্বারা যেকোন অপকর্ম সাধন করা যাবে। আস্তে আস্তে সেই জায়গাটি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে রাজনৈতিক দল গুলো। এখানে ছাত্র রাজনীতির একটা বড় ব্যর্থতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

আর একটা বড় পরিবর্তন যেটা হয়েছে সেটা হলো, বিগত বছর গুলোতে শিক্ষার মান ক্রমাগত নিচের দিকে নেমেছে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর প্রশাসন  বিক্রি হয়ে গেছে ক্ষমতাসীন দলের কাছে, তাই এই প্রশাসনের নাকের ডগায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চললেও কিচ্ছু বলার বা করার সাহস তারা রাখে না। তাই আজকাল হরহামেশাই শোনা যায় কলেজের অধ্যক্ষকে পুকুরে ফেলে দিলো ছাত্রলীগের কর্মীরা। ভাবতেই অবাক লাগার কথা একজন শিক্ষককে পুকুরে ফেলে দেয় তার ছাত্র, কিন্তু অবাক আসলে আমাদের লাগে না। কারণ আমরা দিনের পর দিন বলে আসছি এই শিক্ষার মান নিয়ে, আমরা বলে আসছি ক্যাম্পাসের পরিবেশ নিয়ে, সব সংগঠনের সহ অবস্থান নিয়ে, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে তখন এই সকল কথায় কর্ণপাত করেনি উপরে বসে থাকা কর্মকর্তারা তাই পুকুরে ফেলে দেওয়া তাদের কর্মফল হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভিসি ও অন্যান্য নিয়োগ নিয়ে বড় রকমের দুর্নীতি হয় আমাদের রাষ্ট্রে। যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যাক্তি নয় এখানে যারা পা চাটতে পারে তারাই ভালো করতে পারে সর্বত্র। তাই আওয়ামীলীগের ক্ষমতার জোরে যেই লোক ভিসি হয় ছাত্রলীগের ছেলেরা তাকে মারলেও তার কিছুই করার থাকে না। মেরুদণ্ড সোজা করে কথা বলার সৎ সাহস এখানে সবার নেই। আর যেই গুটিকয়েক লোকের আছে তারা তাদের প্রতিবাদ ঠিকই জারি রাখে, সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা কথা বলে যায়।

আমরা ভালো করেই বুঝতে পারি যে এই কয় দিন যাবত এই যে ঢাবি ক্যাম্পাস অস্থির হয়ে উঠেছে সেটার পেছনে একটা বড় কারণ সামনের জাতীয় নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচন কে কেন্দ্র করেই রাজনৈতিক দল গুলো তাদের শক্তি প্রদর্শন করে মাঠ গুছানোর কাজ শুরু করেছে। একটা দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাসে ছাত্রদল অনুপস্থিত থাকলেও এই সময়ে তাদেরকে নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যেই ক্যাম্পাসে থাকতে হচ্ছে। অপর দিকে ছাত্রদলের এই থাকাকে মেনে নিতে পারছেনা ছাত্রলীগ। কারণ একক আধিপত্য চালানোর অভ্যাস তাদের দীর্ঘ দিনের। তাছাড়া তাদের ফাদার সংগঠনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া আছে জাতীয় নির্বাচনের আগে ছাত্রদল যাতে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে না পারে। যদি লক্ষ্য করি বুঝতে পারবো এই দুই ছাত্র সংগঠনের শক্তির উপর অনেকটা নির্ভর করবে জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতার খেলায় জেতা হারার প্রশ্ন। আর রাজনৈতিক দলের এই ক্ষমতার খেলার জন্যেই আজকে বার বার ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত হতে হচ্ছে। এমন কি এই দল গুলোর ভেতরেও আবার ভিন্ন ভিন্ন নেতা ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ মেইনটেইন করে। নিজ দলের ভেতরেও তাই দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। কিছু দিন আগেও আমারা চট্টগ্রামে মেডিকেলের ছাত্রদের দুই পক্ষের সংঘর্ষের খবর দেখেছি যারা সবাই ছাত্রলীগের কর্মী। পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রতি বছর নিজেদের কোন্দলেই বেশী হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় ক্ষমতাসীনদের ভেতর। মতের মিল না হলে বা নেতার কথা রাখার জন্যে নিজের সহযোদ্ধার গায়ে হাত দিতেও একবার ভাবে না এই সকল কর্মীরা। আসলে যেই শিক্ষার মধ্য দিয়ে তারা ছাত্র রাজনীতি করে সেটি কোন রাজনৈতিক শিক্ষা তো না বরং মানুষ হওয়ার শিক্ষাও তাদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়। অস্ত্র, টাকা, ক্ষমতা, মাদক দিয়ে আচ্ছন্ন করে রেখে বাকি সব মনুষ্যত্ব তাদের থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, নয়তো কি ভাবে দোয়েল চত্বরে একজন নারীকে এতো গুলো মানুষ রূপি পশু লাঠি দিয়ে প্রহার করলো। যেকোন মানবিক মানুষের পক্ষেই এটি সম্ভব হওয়ার কথা না। আবার অনেকে বলার চেষ্টা করছে যে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের নারী কর্মীদের হাতেও লাঠি বা বিভিন্ন অস্ত্র দেখা যাচ্ছে। এখানে মনে রাখতে হবে যে নারী বা পুরুষ কোন বিষয় নয়, ক্ষমতার লোভই এখানে সবচাইতে বড় ব্যাপার। আর এই সংগঠনের প্র‍্যাক্টিস অনুযায়ী হাতে লাঠি, রড, মাথায় হেলমেট নিতে না পারলে সামনের দিনে নেতা হওয়া সম্ভব হবে না তাই ক্ষমতার লোভে এরা ছাত্রনেতা তো দুরের কথা মানুষ না হয়ে অমানুষ হয়ে উঠছে ক্রমাগত।

এই ভুখন্ডের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসের মতো এতো লড়াই, এতো অর্জনের ইতিহাস কোথাও দেখা যায় না, শুধু ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭১ নয় এর পরেও প্রতিটি লড়াইয়ে ছাত্ররা লড়েছে। শুধু নিজের অধিকার নয় কৃষক, শ্রমিক আপামর মানুষের জন্যে ছাত্ররা লড়েছে। ধানের দাম বাড়ানোর জন্যে কথা বলেছে, নিরাপদ সড়কের জন্যে রাস্তায় নেমেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে স্লোগান তুলেছে, ছাত্র রাজনীতির নামে যেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধেও লড়াই চলছে। গেস্ট রুম, গণরুম বন্ধের দাবিতে, সকলের মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যে আমরা অল্প কিছু মানুষ কথা বলেই যাচ্ছি। কিন্তু প্রয়োজন সকল বিবেকবান মানুষের ঐক্যবদ্ধ একটা সংগ্রাম। এই অন্যায় কে ছাত্র রাজনীতি বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না, বরং প্রকৃত ছাত্র রাজনীতির চর্চাকে ফিরিয়ে আনতে হবে যাতে এই দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আবার ফিরিয়ে আনা যায়। অল্প কিছু ছাত্রের এই ক্ষমতার লোভ রয়েছে এর বাইরে একটা বড় সংখ্যক ছাত্র রয়ে গেছে যারা নিজেদের মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দেয় নি। প্রয়োজন তাদের কথা বলা, শুধু ফেসবুকে প্রতিবাদ না করে যদি রাজপথে এই ছাত্ররা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে তবেই আমাদের প্রাণের ক্যাম্পাস গুলোতে আর অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যাবে না, দেখতে হবে না হেলমেট বাহিনী বা লাঠিয়াল বাহিনী। বরং সব মানুষের পক্ষ নিয়ে ছাত্ররা কথা বলবে, ছাত্ররা শ্রমিকের পাশে, কৃষকের পাশে দাঁড়াবে, সকল অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়াবে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না। আর এই অবস্থা তৈরী করা পর্যন্ত আমরা লড়াই করে যাবো, যেমন করে লড়াই করে রাজু, সঞ্জয়, আসলাম, মতিউল আরো অসংখ্য নীল পতাকার সৈনিক জীবন দিয়েছিলো। তাদের রক্তে রাঙ্গানো পথেই আমরা হেঁটে যাবো। আর বলে যাবো আমাদের বিদ্যাপিঠ কখনো সন্ত্রাসীদের আবাসস্থল হতে পারে না।

লেখকঃ সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন