প্রোপাগাণ্ডার রাজনীতি

সুমাইয়া সেতু


প্রোপাগাণ্ডার রাজনীতি

বর্তমান সময়ের একটা বহুল পরিচিত শব্দ এই প্রোপাগাণ্ডা, কম বেশি আমরা সবাই এই শব্দের সাথে পরিচিত। দেশে দেশে যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ব্যাপারে প্রোপাগাণ্ডা ব্যাবহৃত হয়ে থাকলেও অতীতে যেই অর্থে ব্যবহৃত হতো বর্তমানে সেই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। অতীতে মানুষ প্রোপাগাণ্ডা বলতে বুঝতো বিভিন্ন সাধারণ প্রচারণাকে, কিন্তু বিংশ শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে এই অর্থ পরিবর্তিত হতে থাকে। এই বাক্যের প্রয়োগের বা ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে প্রচারণা হয়ে যায় অপপ্রচার বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণা। পৃথিবীব্যাপি এই প্রোপাগাণ্ডা বিভিন্ন কারণে মানুষ ব্যবহার করছে যুগের পর যুগ। অতীতে একে প্রোপাগাণ্ডা বলা না হলেও এই উদ্দেশ্য মূলক প্রচারণা ছিলো সব যুগেই। বিশেষত এর মাধ্যমে ব্যক্তি বা দেশ বা কোন প্রতিষ্ঠান একটা বড় কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে থাকে। জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রোপাগাণ্ডার কারণে কতো দেশে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তার কোন হিসেব নেই।

বড় বড় উদ্দেশ্যের বাইরে যেয়েও অনেক সময় খুব ছোট কোন কারণেও মানুষ নিজের শত্রুতা বা মনের হিংসা মেটানোর জন্যে নানাবিধ মিথ্যা তথ্য ছড়ায় চারপাশে। যাকে প্রতিপক্ষ ভাবা হচ্ছে তাকে ছোট করার জন্যে, তাকে ঘায়েল করার জন্যে প্রোপাগাণ্ডা এখন খুবই কমন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদ্দেশ্য প্রণোদিত এই সকল প্রচারণায় কখনো সম্পূর্ণ মিথ্যা, কখনো আংশিক সত্য প্রকাশ করা হয়। তবে একবার না একাধিকবার একই বক্তব্য তুলে ধরা হয়, যাতে মিথ্যা তথ্যও সত্যের মতো শোনায়। যতক্ষণ পর্যন্ত নির্ধারিত মানুষের মধ্যে কাঙ্খিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দেখা না যায় ততক্ষণ ব্যক্তি তার প্রোপাগাণ্ডা অব্যাহত রাখে। আর মানুষ একই কথা বারবার নানা মাধ্যমে শুনতে শুনতে এক সময় তা বিশ্বাস করতে শুরু করে।

এই প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর জন্যে ব্যবহার করা হয় নানা মাধ্যম। যেমন বর্তমান সময়ে দ্রুত যেকোন তথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। তাছাড়া ব্যক্তিগত আলোচনা, টেলিভিশন, বিভিন্ন লেখা, ছবি, প্রচারপত্র ইত্যাদির মাধ্যমেও এই সকল তথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এই অপপ্রচার ছড়ানোর পদ্ধতিও পরিবর্তিত হয়েছে। যতরকমভাবে আবেগ দিয়ে যুক্তির বাইরে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেই চেষ্টাই করা হয় এর মাধ্যমে, সঠিক তথ্য যাতে মানুষের নিকট না পৌঁছায় সেটির দিকেও লক্ষ্য রাখে প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোকারীরা। এই কাজকে মনোবিজ্ঞানের খেলা বললেও খুব একটা ভুল হবে না।

ধর্মীয় ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের পাশাপাশি রাজনীতিতে এই বিষয়ের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, বর্তমান সময়ে এই প্রভাব আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে চারপাশে। তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির কারণেই আজকাল সহজে এটি ছড়ানো যায় দ্রুত সময়ে। একটা সহজ উদাহরণ দিতে হলে আমরা আমাদের বাংলাদেশ টেলিভিশনের কথাই ধরতে পারি। দেশের যত অরাজকতা, মানুষের দুঃক্ষ-দুর্দশা কোন কিছুই সেখানে দেখানো হয় না, সত্য ঘটনা গুলোকে চেপে যাওয়া হয়। সেখানে দেখানো হয় কেবল বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন, দেখানো হয় পদ্মা সেতুর উন্নয়ন। কারণ এই বিটিভি এদেশের সরকার পরিচালিত, তাই বিটিভির যেকোন কার্যক্রমই সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেই মানুষ রেগুলার বিটিভি দেখে তার মনে হতেই পারে দেশে কোন অভাব অনটন নেই, নেই কোন খুন, ধর্ষণ। আবার যখন সুন্দরবন ধ্বংস করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছিলো ক্ষমতাসীন দল তখন বারবার বিশেষজ্ঞ ও সচেতন মানুষ এর ক্ষতি তুলে ধরেছিলো। সেই সময় পাল্টা প্রোপাগাণ্ডা হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছিলো যে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে যাবে। এই প্রচারণার কারণে অনেকেই হয়তো ভেবে নিয়েছে যে বিষয়টি সত্যি এই রকম সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে না আবার বিদ্যুৎ ও গুরুত্বপূর্ণ।

এই রকমভাবে অসংখ্য প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হয়ে থাকে মানুষের ভাবনার জগৎ নিয়ন্ত্রণে। পুঁজিবাদের এইটা একটা বড় রকমের ‘ট্রামকার্ড’ বলা চলে। বিভিন্ন রাষ্ট্র ইচ্ছাকৃত অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্কে তার জনগণের নিকট এমন বার্তা দিয়ে থাকে যাতে সেই দেশের প্রতি ঘৃণার জন্ম নেয় মনে। এই রকম বড় ঘটনার সাথে সাথে ছোট ছোট ভাবে ব্যক্তিগত যেই সকল অপপ্রচার করা হয় সেগুলোর একটা বড় অংশ এমন মানুষের উপর করা হয় যারা বয়সে ছোট, বা মানসিক বয়সে ছোট, যাদের জানা বোঝার জায়গা কম। কারণ এই ধরনের মানুষকে সহজে যেকোন কথা বিশ্বাস করানো সহজ। যেকোন কথা শুনলেই সেটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিনা সেটি না জেনে গ্রহণ করার প্রবণতা বা অন্যকে সহজে অনুকরণ করে তা আরও মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি যারা করে তারা প্রকৃত অর্থেই কম জানা মানুষ। এই মানুষদেরকে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর কোন স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে এক শ্রেনীর মানুষ এই সকল নিন্দনীয় কাজ করে থাকে। যেমন আমরা দেখতে পাই এদেশের রাজনীতিতে কয়েকটি দল থাকে যারা প্রতিনিয়তই একে অন্যের বিরুদ্ধে নানা প্রোপাগাণ্ডা ছড়াতে থাকে। বস্তুনিষ্ঠ তথ্য না প্রচার করে নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে বিরোধী দলের নামে নানা উদ্দেশ্য মূলক প্রচারণা আমরা হরহামেশাই দেখি। এমনকি নিজের দলের অন্য নেতা যাতে উচ্চপদে না যেতে পারে সেই জন্যে কর্মীদের মাঝে নানা প্রোপাগাণ্ডা ছড়াতেও ভাবে না তারা। এছাড়াও আমরা দেখি এদেশের রাজনীতিবিদরা রাজনীতিতে নারীর অংশ গ্রহণের লক্ষ্যে সভা সমাবেশে বড় বড় বক্তব্য দেয়, আবার রাজনীতি করে যে নারীরা সমাজের অন্য মানুষদের কাছে তাদেরকে খারাপ বানিয়ে রাখার জন্যে বিভিন্ন প্রোপাগাণ্ডা তারাই ছড়ায় চারপাশে। অনেক সময় নিজে বড় নেতৃত্বে যেতে পারেনি বলে অন্য কোন নারী উচ্চ আসনে বসুক এটাও তারা চায় না। তাই এই সমস্ত নারীদের নামে নানা প্রোপাগাণ্ডা তারা ছড়ায় চারপাশে। সামান্য ব্যাক্তিগত না পাওয়ার জায়গা থেকে অতৃপ্ত আত্মার মতো তারা চারপাশের অন্যদের ক্ষতি করে যায় দিনের পর দিন।

এই রকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে চারপাশের। এই ধরণের ব্যক্তিরা নিজের স্বার্থের বাইরে আর কোন কিছুই ভাবতে পারেনা। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এরা কখনোই হতে পারে না। বিরোধীদল তো বটেই কোন কোন ক্ষেত্রে নিজ দলের মানুষের ক্ষেত্রেও তারা এই ধরনের প্রোপাগাণ্ডা ছড়ায়। ভিন্ন ভিন্ন দেশে এই প্রোপাগাণ্ডা শব্দটির ভিন্ন অর্থ থাকলেও বর্তমানে এটি নেতিবাচক অর্থই প্রকাশ করে। মূলত রাজনৈতিক ভাবেই এই শব্দের প্রয়োগ হয়ে থাকে সারা বিশ্বে। এই উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণার ব্যপারটি আবার সব সময় ঠিক মতো করা সম্ভব হয় না, মানুষ একটা সময় এটি ধরে ফেলতে পারে। সেই সময় প্রোপাগাণ্ডা সৃষ্টিকারীদের ঘৃণা করে সেই স্থানের জনগণ।

যেকোন ঘটনা সমাজে সকলের সামনে তুলে ধরতে হলে তার পূর্বশর্ত হতে হবে সংবাদটির বস্তুনিষ্ঠতা। তার বদলে যখন মিথ্যা তথ্য প্রদান করে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করা হয় বা নিজস্ব গোপন কোন উদ্দেশ্য হাসিল করা হয় তখন এটি বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। যারা নিজের পেট চালানোর বাহন হিসেবে প্রোপাগাণ্ডাকে বেছে নেয় তাদের আবার এই সকল বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে মাথা ব্যাথা করার সুযোগ থাকে না। তারা তখন বেতন ভুক্ত কর্মচারী হয়ে উদ্দেশ্য সাধন করে বিভিন্ন কিছু ছড়ানোর মাধ্যমে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও বিজ্ঞাপনেও আমরা এই বিষয় দেখতে পাই। সাধারণ প্রচারণা যেখানে মানুষকে সকল তথ্য যাচাই বাছাই করার পরামর্শ দেয়, অন্য বা ভিন্ন বক্তব্য গ্রহণের পরামর্শ দেয় সেখানে প্রোপাগাণ্ডা মানুষকে বক্তব্যের শেষ প্রান্তে নিয়ে যায় যেখানে আর কোন যাচাই বাছাই এর সুযোগ থাকে না। উপসংহারে নিয়ে যায় যে কোন বক্তব্য।

এইটিকে ছড়ানোর জন্যেও প্রোপাগান্ডিস্ট কে লক্ষ্য রাখতে হয় যেখানে সে বক্তব্যটি তুলে ধরছে সেই স্থানটি অনুকুলে কিনা, অনেক সময় দেখা যায় যেকোন একটি ঘটনাকে একপক্ষিক ভাবে বিশ্লেষণ করেও এটি ছাড়ানো যেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সমস্ত প্রোপাগাণ্ডার উৎস প্রকাশিত হয়না কারণ যদি উৎস প্রকাশিত হয় আর সত্যটা সবার সামনে চলে আসে সেক্ষেত্রে প্রচারকের অবস্থা সংকটাপন্ন হতে পারে।

প্রোপাগাণ্ডার একটা বড় অংশ ব্যবহৃত হয়ে থাকে ধর্মের ব্যপারে। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের প্রতি নানা বিদ্বেষ তৈরি করে নানা মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে। বিভিন্ন ধর্মের যেসকল ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয় সেখানেও আশ্রয় নেওয়া হয় নানা প্রোপাগাণ্ডার। এছাড়াও যুদ্ধের সময় এই অপপ্রচার ছড়ানোর মাধ্যমে শত্রু পক্ষের প্রতি ঘৃণা জন্মানো হয়। নানা মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে জাতিবিদ্বেষ তৈরি করা হয়ে থাকে। এমন পরিস্থিতি করা হয় যেই পরিস্থিতিতে মানুষ আর নিজের যুক্তি দিয়ে ভাবার মতো অবস্থায় থাকেনা বরং আবেগী হয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় তাড়াহুড়ো করে। প্রোপাগাণ্ডা যারা ছড়ায় তারা বেশিরভাগ সময়ে প্রকাশ্যে আসতে চায় না, তারা চায় পেছনে থেকে বক্তব্যটা তুলে ধরতে কারন ধরা পড়ে গেলে বিপদে পরার ভয় থেকে যায়।

আমরা যেই সকল বই পুস্তক পড়ি সেখানেও অনেক বিকৃত ইতিহাস বা খণ্ডিত ইতিহাস তুলে ধরা হয়। আবার অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়না উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে। পাঠ্যপুস্তকে মানুষ যা পরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা বিনা বিচারে মেনে নেয় আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এই রকম নানা প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হয় নানা সময়ে। ক্ষমতায় থাকা দল আবার নিয়ন্ত্রণ করে সেই সময়ের পত্রিকা ও মিডিয়া গুলোকে। বিভিন্ন বুদ্ধিজীবিদের কিনে নিয়েও অনেক সময় পেইড লেখা লেখানো হয়। এতে সাধারণ মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হয়। পুঁজিবাদী আগ্রাসনের একটা বড় হাতিয়ার হিসেবে নানাভাবে বর্তমানে এই প্রোপাগাণ্ডা ব্যবহৃত হচ্ছে। এর পেছনে কত টাকা খরচ করছে পুজিপতিরা তার কোন হিসেব নাই। শুধু মাত্র মানুষের ভাবনাকে নানা ভাবে ভুল বুঝিয়ে তাদের ইচ্ছামতো পরিচালিত করতে পারছে বলেই জনগন নিজের অধিকার সচেতন না হয়ে মরিচীকার পেছনে ছুটছে। আর গোটা সমাজের বিভিন্ন স্তরে ব্যক্তিগত পাওয়া, না পাওয়ার হিসেব মেলাতেও মানুষ জারি রেখেছে এই অপপ্রচার।

তাই যেকোন তথ্য জানা মাত্রই তা সঠিক বলে ধরে নেওয়া কোন সচেতন মানুষের কাজ নয়। বরং সেই তথ্য প্রকাশের যথাযথ কারন খোজ করাই সেই মুহুর্তে করনীয়। রাজনৈতিক ভাবে আরো অনেক বেশি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে প্রতি মুহূর্তে এই সকল প্রোপাগাণ্ডাকে মোকাবেলা করতে হয়। ভুল করেও এর ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। আর নিজের সম্পর্কে কেউ এই সব ছড়াচ্ছে মনে হলে সচেতনভাবে সেটি লক্ষ্য রাখতে হবে নিজের কাজের গতি আরো বাড়িয়ে দিতে হবে। ইতিবাচকতা দিয়েই এই নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে হবে সকলকে।

 

লেখকঃ সুমাইয়া সেতু, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।