প্রসঙ্গ ৬০ বিঘা

তারিক হোসেন মিঠুল


প্রসঙ্গ ৬০ বিঘা

'ব্যক্তি পর্যায়ে ৬০ বিঘা কৃষি জমি থাকতে পারবে'- এমন একটি আইন নিয়ে বেশ কিছুদিন লেখালেখি ও আলোচনা চলছে সর্বমহলে। আইনটি নিঃসন্দেহে ভালো। সমবন্টন বা ভূমির উপর সবার অধিকার প্রতিষ্ঠায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারতো। স্বাধীনতার ঠিক পরপর বংলাদেশের ভূমি সংস্কার আইনে পরিবার প্রতি ১০০ বিঘা ভূমির মালিকানার বিষয়টি এক্ষেত্রে একটি ভাবনার খোরাক হতে পারে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সময় দেশের মোট জনসংখ্যা ও আবাদী জমির পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে এই বন্টন পদ্ধতি আইনে পরিনত হয়। সেই আইনে যথাযথভাবে শতাংশ, কাঠা, বিঘা, একরসহ সব ধরণের পরিমাপের পরিমান ইঞ্চি-ফুটে বিস্তারিত বলা আছে।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবার পর বতর্মানে দেশের জনসংখ্যা মতান্তরে ১৭ -১৮ কোটি পেরিয়ে গেছে, যা ৫০ বছর আগে ছিল আনুমানিক সাড়ে সাত কোটি। অর্থাৎ বতর্মানের চেয়ে প্রায় ১০ কোটি কম।

সাধারণভাবে যদি একটি পরিবারের ৫ জন সদস্য থাকে, তাহলে তখ পরিবার প্রতি ১০০ বিঘা হিসাবে জনপ্রতি কৃষিজমির পরিমান ধার্য ছিলো ২০ বিঘা। কিন্তু ১০ কোটি মানুষ বৃদ্ধির পর এখন মাথাপিছু ৬০ বিঘা কৃষিজমি থাকতে পারবে বলা হচ্ছে! অর্থাৎ ৫০ বছর পর এসে এখন তিনগুন বেশি কৃষিজমি রাখবার আইন করা হচ্ছে!

এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে যে, তাহলে কি আমাদের দেশের মোট ভূমির পরিমান তিনগুন বেড়েছে? নাকি অতিরিক্ত জনসংখ্যার বাসস্থানের জন্য কৃষিজমির রূপ পরিবর্তিত হয়েছে ও কৃষিজমি কমেছে? তবে হ্যাঁ, নদ-নদীতে চর জেগেছে এবং সেখানে কিছু খাসজমি বেড়েছে; যা ভূমিহীনদের মধ্যে বন্টন করা ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় স্থাপনার জন্য ব্যবহার করা হয়। যদিও প্রকৃতপক্ষে কতজন ভূমিহীন মানুষ সে জমি পেয়েছেন তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। সে আলোচনা আজকের আলোচনার বিষয় নয়।

আমাদের দেশে অনেক আইন হয়। শাসকগোষ্ঠী সবসময়ই সেই আইনকে জনগণের জন্য করা হচ্ছে বলে বারবার প্রচারে নিয়ে আসেন। কিন্তু তারা কি একবারও বিষয়ে গভীরে প্রবেশ করে দেখেননি যে, অংকের হিসাবে এসব বুলি আদতেই জনগণের পক্ষের নয়? তাহলে কার স্বার্থে ও কেন আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে এধরণের জনবিরোধী আইন পাশ করা হয়? জনসংখ্যা ও কৃষিজমির আনুপাতিক হারে জনপ্রতি কৃষিজমি রাখতে পারার বিষয়টির যথাযথ নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি।

একটি গোজামিল -

আমাদের দেশের সব অঞ্চলে এখনো জমির মাপের নিক্তি একরম নয় অর্থাৎ আইনানুসারে হচ্ছে না। একেক এলাকায় একেকভাবে পরিমাপ করা হচ্ছে। যেমন, নেত্রকোণা-ময়মনসিংহে এক কাঠা= দশ শতাংশ! দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কোথাও ৫২ শতাংশে বিঘা, কোথাও ৬০ শতাংশে আবার কোথাও ১২০ শতাংশে হিসাব করা হয় এবং এই কাঠা ও বিঘা হিসাবেই জমির মূল্য নির্ধারণ করে বেচাকেনা চলছে হরদম! অথচ আইনানুসারে সার্ভে পরিমাপ ৩৩ শতাংশে বিঘা। সেসব এলাকায় বিঘা ও কাঠার ক্ষেত্রে এই সার্ভে পরিমাপকে অনুসরণ করা হয় না। যদিও দলিলে শতাংশ উল্লেখ করা হয়। এখানে একটি ধাপ্পাবাজি কারবার চলে আসছে বহুকাল যাবৎ! এটি একটি ওপেন-সিক্রট বিষয়।

তাই আইন করতে হলে-

আইনের দ্বারা

জনসংখ্যা ও কৃষিজমির অনুপাত;

জনসংখ্যা ও ভিটামাটির অনুপাত;

নগর/শহরের জনগণ ও ভূমির অনুপাত - ইত্যাদি বিশ্লষণ করে তারপর এসব জমি অধিকারের বন্টন নীতিমালার মাধ্যমে ভূমি সংস্কার আইন প্রনয়ণ ও যথাযথ বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি।

তা নাহলে ভূমিদস্যুপনা দিনদিন আরো বাড়বে এবং ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা, সঙ্কা ও সংকট বাড়বে। এক কথায় ভূমি সংকট আরো প্রকট হবে।

জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে এই সংকট অতিক্রম করা সম্ভব। আর সেজন্য চাই সঠিকভাবে হিসাব করে ভূমির মালিকানা আইন প্রণয়ন ও যথাযথ বাস্তবায়ন।