ঢাকায় বাম জোটের বিশাল সমাবেশ

সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি বাম জোটের

সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি বাম জোটের

বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার দৃঢ় ঘোষণা দেন। একইসাথে অবিলম্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য জনগণকে আহবান জানান।

আজ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বিকেল ৪ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় সমাবেশ থেকে বক্তারা ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের জন্য নীতিনীস্ঠ বাম প্রগতিশীল শক্তিকে শক্তিশালী করার আহবান জানান।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরামের সমন্বয়ক কমরেড মাসুদ রানার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভা পরিচালনা করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক কমরেড মিহির ঘোষ। সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)'র র সাধারণ সম্পাদক কমরেড রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)',র সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক কমরেড ইকবাল কবির জাহিদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড শহিদুল ইসলাম সবুজ ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সভাপতি কমরেড আব্দুল আলী।

সভায় কমরেড মাসুদ রানা বলেন, “দেশের জনগণ একদিক অর্থনৈতিকভাবে সংকটে আছে, অপরদিকে রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তার ভোটের অধিকার নেই, কথা বলার অধিকার নেই। আওয়ামী লীগের এই শাসনে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ীরা। তাদেরকে রক্ষার জন্য আওয়ামী লীগ যা যা করতে হয় সব করছে। ফলে আওয়ামী লীগের উপর জনগণ প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ। জনগণ পরিবর্তন চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বৃহৎ ব্যবসায়ী শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী অন্য কোন দল আসলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। আজকের দিনে এই পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের রক্ষাকারী হয়ে যারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করবে তাদেরকে ফ্যাসিবাদের পথে হাঁটতেই হবে। তাই আজকের দিনে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো রক্ষা করতে হলে বাম গণতান্ত্রিক শক্তির আন্দোলকে শক্তিশালী করতে হবে। আর চূড়ান্ত মুক্তি আসতে পারে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

কমরেড রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “যে নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারে নি, অংশগ্রহণ মুলক হয়নি, অথচ ফলাফল ঘোষিত হয়েছে, সেই নির্বাচন নিয়ে তো প্রশ্ন থাকবে। কথার মালা সাজিয়ে, প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করে, ভয়-ভীতি দেখিয়ে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে জনগণের কন্ঠ স্তব্ধ করা যাবে না।

তিনি বলেন, গণবিরোধী সিদ্ধান্ত জনজীবনকে দূর্বিষহ করে তুলেছে। অনিয়ন্ত্রিত বাজার সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো মানুষের জীবনকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে। দূর্নীতি লুটপাট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সরকার সর্বত্র আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নাই বরং একের পর এক বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভোট কারচুপির প্রস্ততি সম্পন্ন করছে। এ অবস্থার অবসানে সব মানুষকে রাজপথে নামতে হবে।

তিনি বলেন, শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই আর গণতন্ত্রের লড়াই এক না। মিউজিক্যাল চেয়ারের পরিবর্তনে গণতন্ত্র স্থায়ী হয় না। তাই বামপন্থীরা দুঃশাসনের অবসানের সাথে ব্যবস্থা বদলের সংগ্রাম করছে। বামপন্থীরা ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতি লুটপাটের অবসান ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের অধিকার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। পরিবারতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, জমিদারতন্ত্রের অবসান ঘটাবে।

তিনি বলেন,ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হলে দু: শাসনের মাত্রা বাড়বে।' তিনি সরকারকে হুঁশিয়ারি জানিয়ে বলেন, জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে কেউ ক্ষমতা স্থায়ী করতে পারেনি। এবারও ভোটাধিকার বঞ্চিত করে, কৌশল করে, নির্বাচন কমিশন, আমলা আর নানা মহলকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকার অপচেষ্টা জনগণ রুখে দাঁড়াবে।”

কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন,“ দেশে একটা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন চলছে। এই সরকার একটা ফ্যাসিস্ট সরকার। এরা জনগণের মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে দমনের অস্ত্রে পরিণত করেছে। নিজেদের সকল অন্যায়কে মুক্তিযুদ্ধের আবেগের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখতে চায়। ফলে দুর্নীতি ও দুঃশাসন চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শুধু ধ্বংস করে নাই তার বিপরীতে লুটপাটের চেতনা দ্বারা দেশ শাসন করছে।

এই সরকারের আমলে অর্থনীতিতে লুটপাট চরম রূপ নিয়েছে- আওয়ামী লীগের বড় নেতা ছোট নেতা সকল স্তরের নেতারা ঠিকাদারি, দখল বাণিজ্য, চাকুরি বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, নদী- খাল, বন, পাহাড় দখল কাজের মধ্য দিয়ে টাকার পাহাড় বানিয়েছে। ব্যাংক লুট, ঋণের নামে হরিলুট চলছে। দেশ থেকে টাকা পাচার বাড়ছে।

দ্রব্যমুল্যে নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। পরিকল্পিত এবং পালাক্রমে জিনিসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী সকল দেশের চাইতে বাংলাদেশে খাদ্য পণ্যের দাম বেশি। ওয়াসা, গ্যাস, বিদ্যুৎ খাতে সীমাহীন লুটপাট আর দাম বাড়িয়ে দুর্নীতির বোঝা চাপানো হচ্ছে দেশের জনগণের কাঁধে। শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যয়বহুল করা এবং বাণিজ্যে পরিণত করা।

এরা রাজনীতিকে দুর্বৃত্তদের আশ্রয়স্থলে পরিণত করেছে। একের পর এক কালাকানুন দিয়ে জনগণের কণ্ঠ রুদ্ধ করছে। এরা নির্বাচনকে খেলায় পরিণত করেছে। দেশের সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দিচ্ছে। আমরা দুর্নীতি লুটপাট চাই না, এক দলীয় বা রাতের নির্বাচন চাইনা, মধ্য রাতের নির্বাচন বা একা একা নির্বাচন বা রেফারিকে খেলোয়াড় বানিয়ে নির্বাচন চাইনা। দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট চাইনা, কালো আইন চাইনা, কৃষক শ্রমিক শোষণ চাই না, বিদেশীদের কাছে দেশের সম্পদ তুলে দিতে চাই না। আমরা চাই- দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশদের বিচার, লুটের টাকা উদ্ধার করে জনগণের কল্যানে ব্যবহার করা হোক , দলীয় সরকারের অধীনে নয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন চাই, নির্বাচনী ব্যবস্থা পাল্টে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন, কালো টাকা, সাম্প্রদায়িকতা ও  পেশী শক্তির প্রভাব মুক্ত নির্বাচন চাই। এজন্য সকল দল ব্যক্তি গোষ্ঠিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সরকারের পতনের আন্দোলনকে জোরদার করার আহ্বান জানাই।”

কমরেড ইকবাল কবির জাহিদ বলেন,“সরকার লুটেরা দুর্বৃত্ত টাকা পাচারকারীদের হোতা। প্রধানমন্ত্রী জনজীবনের সংকট নিয়ে তামাশা করছেন। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারসহ ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে দেশে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন কায়েম করা হয়েছে। আমলা পুলিশী রাষ্ট্র বানিয়ে বিদেশীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে রক্ষা পাওয়া যাবে না। জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটানো ছাড়া বিকল্প পথ নেই।”

কমরেড শহিদুল ইসলাম সবুজ বলেন, “ফ্যাসিবাদী দুঃশাসকদের লুটপাট, টাকা পাচার, মুনাফাখোর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের অতিলোভে দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন উর্ধ্বগতিতে শ্রমজীবী মানুষের জীবন আজ দিশেহারা। গার্মেন্টস সহ সর্বস্তরের শ্রমজীবী মানুষেরা প্রতিদিনকার খরচ বাচাতে গিয়ে আধপেটা কিম্বা অনাহারে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। গার্মেন্টস শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ। গার্মেন্টস শ্রমিকদের উৎপাদিত পণ্য দেশের ৮৫% বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলেও তারা বেতন পান বিশ্বের সর্বনিম্ন। অপরদিকে আমাদের ছিল বিশ্বের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী পাটকল, চিনি কল। এই লুটেরা সরকার সকল পাটকল, চিনিকল বন্ধ করে দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিককে কর্মহীন ও নিঃশ্ব করে পথে নামিয়ে দিয়েছে। বুর্জোয়া পুঁজিবাদী এই দুঃশাসনে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবী  মেহনতি মানুষের ঐক্য বদ্ধ লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে, শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার লড়াই জোরদার করার কোন বিকল্প নেই।”

কমরেড আব্দুল আলী বলেন, “এই সরকারের পতনের আন্দোলনে বামজোট রাজপথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সেই লড়াইয়ে সামিল হওয়ার জন্য আপনাদের আহবান জানাই।”

সমাবেশে ঘোষিত কর্মসূচি:

সমাবেশ থেকে আগামী ১৫-৩০ সেপ্টেম্বর পক্ষকালব্যাপী রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ও সারাদেশের উপজেরাতে সমাবেশ, ৫ অক্টোবর ঢাকায় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান, ৮-১৫ অক্টোবর জেলায় ও বিভাগীয় শহরে পদযাত্রা ও সমাবেশের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়।

বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত দলসমূহের কয়েক হাজার নেতাকর্মী মিছিল করে এই সমাবেশ যোগ দেন।