বাংলার মানুষের কাছে নজরুল মেহনতি মানুষের মুক্তিতে বিশ্বাসী স্বাধীনতা ও জাতীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কবি হিসেবে চির জাগরূক থাকবেন। তিনি দীপ্তকণ্ঠে তারুণ্যের জয়গান করেছেন, তরুণ দলকে ঊষার দুয়ারে আঘাত করে রাঙা প্রভাতকে ছিনিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন। এই রাঙা প্রভাত বলতে শোষণ-বঞ্চনার শিকার মানব-মানবীর জীবনের শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তির স্বাদ আস্বাদনের কথা বলা হয়েছে। নজরুল শোষণমুক্ত সমাজে এক মেঘমুক্ত নীলাকাশ রচনা করতে চেয়েছিলেন। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার জন্য হিন্দু-মুসলিমকে হ্যান্ডসেক করাতে চেয়েছেন, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। নজরুল তাঁর সাম্যবাদী কবিতায় হৃদয়ের সবটুকু আবেগ, উচ্ছ্বাসের নির্যাস দিয়েই বলেছেন—
গাহি সাম্যের গান—
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশিছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
নজরুল সব ভেদাভেদ ভুলে মানুষে মানুষে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, মসজিদ-মন্দির-গির্জা যেখানেই যাওনা কেন, আর যত বেশি বেশি বেদ-বাইবেল-গীতা-কুরান-ত্রিপিটক পাঠ কর না কেন, মনের কালিমা যদি দূর করতে না পার, মানুষ হয়ে মানুষকে ভালোবাসতে না পারো, তাহলে তোমার সবকিছু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। কারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে সব ধর্ম, সব যুগাবতার বা সব শক্তির উৎস। সুতরাং মানুষে মানুষে যারা বিভেদ রচনা করে, তারা কখনো প্রকৃত ধার্মিক হতে পারে না। তারা মানুষের শত্রু, মানবিকতার শত্রু। নজরুল এই সব শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। আর তাই আজকে যখন আবার সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন দেখি, তখন নজরুলই আমাদের সামনে শক্তি ও প্রেরণার উৎস হিসেবে প্রতিভাত হন। অসহায় জাতি তথা মানুষকে রক্ষা করার জন্য নজরুলের গগনবিদারী আহ্বান শুনতে পাই তাঁর ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার
‘কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ,
হিন্দু না ওরা মুসলিম জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষÑ সন্তান মোর মার।’
তিনি সব সময়ের জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে অটুট রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁর ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার মধ্য দিয়ে। নজরুল তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়ে আহ্বান জানিয়েছেন সমাজের সব কুসংস্কার-অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য। তিনি আইনের নামে যত শৃঙ্খল রয়েছে, তার সবকিছুকে ভেঙে চুরমার করে দিতে চেয়েছেন। এমনকি তিনি তাঁর জন্য মৃত্যুর সঙ্গেও আপস করতে রাজি নন। সবকিছু ধ্বংস করে সেই ধ্বংসস্তুপে আবার সূর্যোদয় ঘটাতে চেয়েছেন। তিনি যত বঞ্চিত, ব্যথাতুর গৃহহারা পথবাসী পথিক তাদের বুকে গতি সঞ্চার করতে চেয়েছেন। নজরুল এক শোষণমুক্ত শ্রেণিহীন সামাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। আর তাই তিনি অসীম সাহসে বলে উঠতে পেরেছেন—
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা
করি শর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি মহামারি আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য’।
আর তাই নজরুলকে কোনো সময়ের বা দেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা যাবে না। যুগ-যুগান্তর ধরে তিনি আমাদের পথ দেখাবেন, সাহস জোগাবেন এবং যুগে যুগে কালে কালে তিনি মানুষের জ্ঞাতি হয়েই রইবেন।
তারুণ্যের পতাকাবাহী ও সমাজ-সচেতন নতুন সৃষ্টিতে প্রত্যয়ী এই কবিকে তাই তো আমরা বারংবার স্মরণ করি। আমরা যদি আমাদের প্রয়োজনেই তাঁকে অন্তরে ধারণ করতে পারি, তাহলে সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, কায়েমি স্বার্থবাদী তথা যে-কোনো ধরনের অশুভ শক্তি আমাদের মাঝে আসন গাড়তে পারবে না। চারদিকে শ্বাপদকুল যে বিষাক্ততা ছড়াচ্ছে, তা প্রতিহত করা সহজ হবে। দানবের সঙ্গে সংগ্রাম করার জন্য প্রতি ঘরে জন্ম নেবে দুর্বার-দুর্জেয় তারুণ্য। আমরা পথ চেয়ে আছি সে তারুণ্যের প্রতীক্ষায়।